ডিস্টোপিয়া

ছেলেটি জন ড্যানভার শুনতো, মেয়েটি কৃষ্ণকলি।
ছেলেটির প্রিয় ছিল গল্পগুচ্ছ,
মেয়েটির শরৎ রচনাবলি।
ছেলেটি লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাংগতো, মেয়েটি ধীরে।
ছেলেটির মনে ছিল মেয়েটি, মেয়েটি ছিল আনমনে।

দোসর

dscn5290

সংবৃত কিংবা সংবৃত নয়,
সংলগ্ন কিংবা অসংলগ্ন, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। একদা
রাতের নির্মেঘ আকাশে তাকিয়ে
যারা তারা গুনেছিল,
তারা এখন জীবিত কি মৃত, মূর্ত কি বিমূর্ত
সেটিও কোন মৌলিক প্রশ্ন নয়।

শুধু স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত
এই প্রভাতবেলা, এই নির্জন মায়াবি দুপুর কিংবা
শুধু এই সোনালি রোদমাখা পড়ন্ত বিকেল, হয়তো
তাদের কোনোটাকেই মনে রাখে না
এই আজন্ম ক্ষুধার্ত মহাকাল।

তারপরও আমরা হেঁটেছিলাম কিছু পথ।
কখনো একসাথে, কখনো একসাথে নয়।
আমাদের পথগুলো বন্ধুর ছিল কি ছিলনা,
সেই সব প্রশ্নও আজ অবান্তর।

হয়তো আমাদের কিছু মুহূর্ত বাস্তবিক অর্থেই ছিল স্থবির,
সারাজীবন ধরে ভুলে থাকার মতো। হয়তো
কিছু মুহূর্ত এসে ভিড়েছিল লালগলা সারসের
ধূসর ডানায় ভর করে। হয়তো আমাদের
উদগ্র কামনার কাছে
আমাদের বোবা অনুভূতিগুলোরই
নিষ্পেষণ ঘটেছে বারবার।
তারপরও আমরা দুটি দোসর ছিলাম,
মিলেছিলাম হাসি-কান্নায়,
ঝঞ্ঝাটে-নির্ঝঞ্ঝাটে…

যেমন মিলে থাকে
দুটি ডানামেলা গাঙচিল।

তবুও শরত

আজকের শহুরে আকাশটা হতে পারতো সুনীল।
আর তার বুক জুড়ে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলো?
হতে পারতো সেগুলো সাদা;
যেমনটা থাকার কথা এই শরতে।
আজকে আমার শহরে বায়ুমণ্ডলের ওপারের আকাশটা
আমার চোখে যেমন নীল নয়,
মেঘগুলোও তেমনি সাদা নয়।

শরত আসতো আমার শৈশবের গ্রামে, তার
কুয়াশাভেজা শূন্যতা ছড়ানো সবুজ মাঠটায়।
শরত আসতো সব ভুলে ছুটে চলা এক
বালকের মাঝে, যার সদ্য শৈশব পেরোনো মন
হারাতো আকাশ নীলে।
শরত আসতো, এখনো আসে আমার
কৈশোরের গন্ধ মাখানো নীরব আঙিনায়,
শিউলি বিছানো ভেজা সবুজ ঘাসের ডগায়
থাকা এক বিন্দু শরত শিশিরে।

আর এখন এখানে, এই শহরে
শরত আসে ক্যালেন্ডারের নতুন পাতায়,
কাশফুলের রঙিন ফটোগ্রাফে।

সুতপা যেদিন নিজেই লাল কৃষ্ণচূড়া হয়ে যায়

4571220357_b8a0bd9a64_b

লাল লাল ফুল সমেত কৃষ্ণচূড়া বরাবরই খুব প্রিয় ছিল সুতপা’র। বলতো,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?
আমি শুনতাম। শুনতাম আর হাসতাম।
ধুর, পাগলী! এর থেকে বাগানবিলাসের ঝোপ কত সুন্দর দেখতে!
ওই যে পিকলুদের পেছনের বাগানে ফুটে আছে নীল অপরাজিতা?
সেটাই বা কম কিসে!

সুতপা আমার বোন। তখন রোজ বেণী করে স্কুলে যায়।
স্কুল শেষ হলে, আমিই গিয়ে নিয়ে আসি রোজ। স্কুলের মাঠে লাগানো
কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখিয়ে রোজই একই কথা বলে,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?

আমি রোজই শুনি। শুনি আর হাসি।

এককালে বেণী দুলিয়ে স্কুলে যাওয়া ছোট্ট সুতপা একসময়
ভার্সিটি যায়। সেই ছোট্ট সুতপা। যে বলতো,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?

ভার্সিটি বন্ধ। সুতপা আসছে।
পরের দুইদিনই হরতাল। মর্জি হলে তার পরের দুইদিনও।
তাই দেরি না করে সুতপা আজকেই আসছে।
চারটের ট্রেনে। একাই।
সুতপা এখন অনেক বড়।
সেই ছোট্ট সুতপা, যে আমার বোন, লাল কৃষ্ণচূড়া যার বড়ো প্রিয় ছিল।

সুতপা-কে নিয়ে আসাটা আমার অনেক দিনের অভ্যাস।
অন্তত স্টেশন থেকেও তো নিয়ে আসা যায়!
রিক্সা না নিয়ে হেঁটেই রওনা দিই। সৃষ্টিছাড়া
কৃষ্ণচূড়া কি আর দোকানে কিনতে পাওয়া যায়!

স্টেশনে পৌঁছুতে দেরি হয়ে যায়। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা
সুতপা’র ট্রেন তখন জলন্ত অঙ্গার। গাছ না পারলেও
মানুষ তো পারে, নিজেদের শরীরে এমন করে আগুন লাগাতে!

সুতপা আর আসেনি।
সেই সুতপা, লাল কৃষ্ণচূড়া যার বড়ো প্রিয় ছিল। যে বলতো,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?

সেই ছোট্ট সুতপা, যে ছিল আমার বোন,
যে লাল কৃষ্ণচূড়ার কথা ভাবতে ভাবতে একদিন নিজেই
লাল কৃষ্ণচূড়া হয়ে গিয়েছিল।

কয়েকটি নীল ময়ুরের যৌবন এবং বিবিধ

il_570xN.249610804

তোকে কবির কল্পনায় আমি চাইনি কখনো,
আর কখনো সেটা চাইও না আমি। কেবল
আমার জানলার কার্নিশে, বিকেলের পিছলে যাওয়া রোদে
এক জোড়া চড়ুই- যেমন তাদের সব মান-অভিমানের
পালা চুকিয়ে-বুকিয়ে দিয়ে ফুড়ুৎ করে মিলিয়ে যায়;
অসীম নীলে,
তোকে নিয়ে তেমনি চেয়েছিলাম
এক আকাশে পাখির উড়াল হতে।

শুধু নিজের জন্য আমি তোকে চাইনি কখনো,
তা আমি চাইবোও না। কেবল ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে
যে আলো উছলে পড়ে দিক-বিদিক, সে আলো
সারা মুখে মেখে একা ছাদে
তুই যখন গান ধরিস,
সেটা যে আমার পছন্দের রবীন্দ্রনাথের গানই হতে হবে
এমন বিলাসিতা আমার একদমই নেই।
আমি চেয়েছিলাম অপার্থিব সেই আলোয়
তুই কেমন মায়াবী তা দেখতে।

শুধু ঘরকন্নার জন্য হলে তো আমি কতজনকেই পাই!
সব ঘরকন্নাকে চুলোয় যেতে দিয়ে এক মগ চা হাতে
বৃষ্টি দেখার জন্য আমি ক’জনকেই বা পাই! শহুরে
বৃষ্টির দিনে, ইলেকট্রিক লাইনে বসে থেকে থেকে,
বোকার মতো ভিজতে ভিজতে,
জবুথবু হয়ে যায় যে কাক,
যাকে দেখে জীবনে প্রথম বারের মতো মনে হয়, হয়তো
কাক হলে বেশ হতো, তোকে নিয়ে ঠিক সে রকম
শহরের রাস্তায় চেয়েছিলাম
কাকভেজা হতে।

চেয়েছিলাম, যেন হই শুধু তুই আর আমি; আমি আর তুই।
আর যেন পাই কয়েকটি নীল ময়ুরের যৌবন।