সত্যজিৎ রায়ের কোন চলচ্চিত্র নিয়ে এই প্রথম লিখতে বসা। তাই চলচ্চিত্র ছাপিয়ে যদি সত্যজিৎ প্রধান হয়ে উঠেন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বরং সেটাই স্বাভাবিক। সত্যজিৎ রায় তাঁর পুরো জীবনে পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য আর প্রামাণ্যচিত্র মিলিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন সর্বসাকুল্যে ৩৬ টি। এই ৩৬ টির মধ্যে ৩৬ টি নিয়েই আমার ‘নির্বাচিত সত্যজিৎ’, এদের মধ্যে কোন ভেদ-অভেদ নেই, বাছাবাছিও নেই।
এগুলোর যেকোনো একটিকে বাদ দিলেই তিনি হয়ে পড়েন অসম্পূর্ণ। তারপরও এটা আমাদের মানতেই হবে যে, ‘অপু ট্রিলজি’ (পথের পাঁচালি, অপরাজিত, অপুর সংসার) তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ অর্থাৎ ম্যাগনাম ওপাস হয়ে থাকবে সব সময়। কেননা, এই চলচ্চিত্রগুলো সত্যজিৎ এর ‘সত্যজিৎ রায়’ হওয়ার গল্পই শুনিয়ে আসবে চিরকাল।
- পথের পাঁচালী থেকে আগন্তুকঃ
‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে শুরু, ‘আগন্তুক’ দিয়ে শেষ। ১৯৫৫ থেকে ১৯৯১, কেটে গেল ৩৬ বছর। বাংলা চলচ্চিত্র পার করলো এক সোনালি যুগ। ৩৬ বছরে ৩৬ টি চলচ্চিত্র, অর্থাৎ গড়ে ফি বছরে একটি করে! ভারতে পথের পাঁচালি নিয়ে সাধারণের প্রতিক্রিয়া ছিল চোখে পড়ার মতো। The Times of India তে লেখা হয়_
It is absurd to compare it with any other Indian cinema. ‘Pather Panchali’ is a pure cinema.
সত্যজিৎ-এর পরবর্তী ছবি অপরাজিত এর সাফল্য তাঁকে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে। এই ছবিটিতে তরুণ অপুর উচ্চাভিলাষ ও তার মায়ের ভালোবাসার মধ্যকার চিরন্তন সংঘাতকে করুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। বহু সমালোচক, যাঁদের মধ্যে মৃণাল সেন ও ঋত্বিক ঘটক অন্যতম, ছবিটিকে সত্যজিতের প্রথম ছবিটির চেয়েও ওপরে স্থান দেন।
সত্যজিৎ পথের পাঁচালি ও অপরাজিত নির্মাণের সময় একটি ত্রয়ী সম্পন্ন করার কথা ভাবেননি, কিন্তু ভেনিসে এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা শুনে প্রথম তাঁর মাথায় এটি বাস্তবায়নের ধারণা আসে। অপু সিরিজের শেষ ছবি অপুর সংসার নির্মাণ করা হয় ১৯৫৯ সালে । আর এ ছবির মাধ্যমেই সত্যজিতের দুই প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শর্মিলা ঠাকুরের চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে। ছবিটিতে অপুকে দেখানো হয় কলকাতার এক জীর্ণ বাড়িতে প্রায়-দরিদ্র অবস্থায় বসবাস করতে। এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অপর্ণার সাথে অপুর বিয়ে হয়। তাদের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্যতে “বিবাহিত জীবন সম্পর্কে ছবিটির ধ্রুপদী ইতিবাচকতা ফুটে ওঠে”, কিন্তু শীঘ্রই এক বিয়োগান্তক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। একজন বাঙালি সমালোচক অপুর সংসার-এর একটি কঠোর সমালোচনা লেখেন, এবং সত্যজিৎ এর উত্তরে ছবিটির একটি সুলিখিত নিবন্ধ লেখেন – যা ছিল সত্যজিতের কর্মজীবনে একটি দুর্লভ ঘটনা! (সত্যজিতের প্রত্যুত্তরের এরকম ঘটনা আরেকবার ঘটে তাঁর পছন্দেরচারুলতা ছবিটি নিয়ে)।
- এবং অরণ্যের দিন রাত্রিঃ
সাদামাটাভাবে বললে, চার বন্ধুর নাগরিক পরিবেষ্টনীর বাইরে অরণ্যের আদিমতায় নিজেদের আবিষ্কারের গল্প এটা। যদিও তাদের এক এবং একমাত্র পরিকল্পনা ছিল পালামৌ’র জঙ্গলে যথার্থ আরণ্যক হওয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিক পীড়ন থেকে কিছুদিনের জন্য মুক্তিলাভ। লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর কল্যাণে ‘পালামৌ’ এর গুণের কথা আজ আর কারোও অজানা নয়। আর এখানে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ একবারে সকলের চর্মচক্ষুর সামনে নিয়ে এসে হাজির করেছেন অদেখা অথচ চিরচেনা পালামৌকে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ চলচ্চিত্রটির শুরুও তাই সঞ্জীববাবুর ভ্রমণ ডায়েরি ‘পালামৌ’-র শুরুর দিককার দু’টি লাইন দিয়ে-
বঙ্গবাসীদের কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ দেখিলেই তাহাদের আনন্দ হয়। অতএব সেই ক্ষুদ্র পাহাড়গুলি দেখিয়া যে তৎকালে আমার যথেষ্ট আনন্দ হইবে ইহা আর আশ্চর্য কী?
সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মূলত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অরণ্যের দিন রাত্রি’-র চলচ্চিত্র রূপায়ন। যদি আমাকে চলচ্চিত্র ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও বই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এই দুইয়ের মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে আমি সত্যিই খুব একটা বড়সড় বিপদে পড়ে যাব। আমার কাছে দুইটাই অসাধারণ লেগেছে। তবুও বলি, বই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শুরুটা চলচ্চিত্রটার শুরু থেকে বেশি ভালো, আর চলচ্চিত্র ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শেষটা বইটার শেষ থেকে বেশি ভালো হয়েছে।
- চলচ্চিত্র কুশীলববৃন্দঃ
অসীম | সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
---|---|
হরি, হরিনাথ | সমিত ভাঁজা |
সঞ্জয় | শুভেন্দু চ্যাটার্জি |
শেখর | রবি ঘোষ |
সদাশিব ত্রিপাঠি | পাহাড়ি সান্যাল |
অপর্ণা | শর্মিলা ঠাকুর |
জয়া | কাবেরী বোস |
দুলি | সিমি গারেওয়াল |
অতসী | অপর্ণা সেন |
- কাহিনি পরম্পরাঃ
অসীম, শেখর, হরি আর সঞ্জয় চার বন্ধু। ব্যক্তিত্ব আর সামাজিক অবস্থানে চারজনই চার মেরুতে বাস করে। অসীম উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, উচ্চাভিলাষী; চটপটে ও টগবগে যুবক। সঞ্জয় চাপা স্বভাবের, নয়টা-পাঁচটা অফিস করে আর অবসরে সাহিত্যচর্চা করে। হরি স্পোর্টসম্যান, সুঠাম শরীর। আর শেখর চাকরিচ্যুত হয়ে সদ্য বেকার, তার রসবোধ প্রবল। নাগরিক পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তারা বিহারের একটা ছোট গ্রাম পালামৌ’র জঙ্গলে সদলবলে এসে হাজির হয়। তাদের সকলের অনুপ্রেরণা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পালামৌ’।
চলচ্চিত্রটায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই খুব নগন্য; একটা অচেনা, নতুন পরিবেশে রোমাঞ্চের আশায় গেলে যা যা ঘটে থাকে সেগুলোই আরকি। কিন্তু, সেই অপ্রধান ঘটনাগুলোই চরিত্রগুলোকে আমাদের কাছে যেন আরও বেশি প্রকট করে তোলে। যখন মহুয়া খেয়ে তারা রাতের অন্ধকারে মাতলামি করে, স্থানীয় আদিবাসী মেয়ে দুলির সাথে হরি সংক্ষিপ্ত যৌন অভিসারে বের হয়, যখন অপর্ণা প্রেমের প্রতিজ্ঞা হিসেবে একটা পাঁচ টাকার নোটে ঠিকানা লিখে দিয়ে অসীমকে দেয় আর অন্যদিকে বাংলোর ভিতরে মুখচোরা সঞ্জয় জয়ার তীব্র কামনায় সাড়া দেয় তখন।
সত্যজিৎ নিজে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ নিয়ে মেরী সিটনের কাছে এক চিঠিতে বলেছিলেন,
‘ চলচ্চিত্রটির প্রথম অর্ধাংশে আছে মৃদু রসবোধের উপস্থিতি, কিন্তু আস্তে আস্তে সেটা এক অনন্য সাবলীলতায় একটা ভাবগম্ভীর পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়’।
আসলেই তাই। একদিন সকালে তাদের আবার সেই চিরচেনা শহরের দিকে যাত্রা করতেই হয়। কিন্তু, এইবার নিশ্চয় তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চয় আগের থেকে ঢের বেশি, নিশ্চয় তারা সকলেই আগের থেকে অনেক বেশি পরিণত।