সুতপা যেদিন নিজেই লাল কৃষ্ণচূড়া হয়ে যায়

4571220357_b8a0bd9a64_b

লাল লাল ফুল সমেত কৃষ্ণচূড়া বরাবরই খুব প্রিয় ছিল সুতপা’র। বলতো,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?
আমি শুনতাম। শুনতাম আর হাসতাম।
ধুর, পাগলী! এর থেকে বাগানবিলাসের ঝোপ কত সুন্দর দেখতে!
ওই যে পিকলুদের পেছনের বাগানে ফুটে আছে নীল অপরাজিতা?
সেটাই বা কম কিসে!

সুতপা আমার বোন। তখন রোজ বেণী করে স্কুলে যায়।
স্কুল শেষ হলে, আমিই গিয়ে নিয়ে আসি রোজ। স্কুলের মাঠে লাগানো
কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখিয়ে রোজই একই কথা বলে,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?

আমি রোজই শুনি। শুনি আর হাসি।

এককালে বেণী দুলিয়ে স্কুলে যাওয়া ছোট্ট সুতপা একসময়
ভার্সিটি যায়। সেই ছোট্ট সুতপা। যে বলতো,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?

ভার্সিটি বন্ধ। সুতপা আসছে।
পরের দুইদিনই হরতাল। মর্জি হলে তার পরের দুইদিনও।
তাই দেরি না করে সুতপা আজকেই আসছে।
চারটের ট্রেনে। একাই।
সুতপা এখন অনেক বড়।
সেই ছোট্ট সুতপা, যে আমার বোন, লাল কৃষ্ণচূড়া যার বড়ো প্রিয় ছিল।

সুতপা-কে নিয়ে আসাটা আমার অনেক দিনের অভ্যাস।
অন্তত স্টেশন থেকেও তো নিয়ে আসা যায়!
রিক্সা না নিয়ে হেঁটেই রওনা দিই। সৃষ্টিছাড়া
কৃষ্ণচূড়া কি আর দোকানে কিনতে পাওয়া যায়!

স্টেশনে পৌঁছুতে দেরি হয়ে যায়। প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা
সুতপা’র ট্রেন তখন জলন্ত অঙ্গার। গাছ না পারলেও
মানুষ তো পারে, নিজেদের শরীরে এমন করে আগুন লাগাতে!

সুতপা আর আসেনি।
সেই সুতপা, লাল কৃষ্ণচূড়া যার বড়ো প্রিয় ছিল। যে বলতো,
আর কোন ফুল দেখতে এর থেকেও সুন্দর হয়, দাদা?
আর কোন গাছ পারে নিজের শরীরে এমন করে
আগুন লাগাতে?

সেই ছোট্ট সুতপা, যে ছিল আমার বোন,
যে লাল কৃষ্ণচূড়ার কথা ভাবতে ভাবতে একদিন নিজেই
লাল কৃষ্ণচূড়া হয়ে গিয়েছিল।

কয়েকটি নীল ময়ুরের যৌবন এবং বিবিধ

il_570xN.249610804

তোকে কবির কল্পনায় আমি চাইনি কখনো,
আর কখনো সেটা চাইও না আমি। কেবল
আমার জানলার কার্নিশে, বিকেলের পিছলে যাওয়া রোদে
এক জোড়া চড়ুই- যেমন তাদের সব মান-অভিমানের
পালা চুকিয়ে-বুকিয়ে দিয়ে ফুড়ুৎ করে মিলিয়ে যায়;
অসীম নীলে,
তোকে নিয়ে তেমনি চেয়েছিলাম
এক আকাশে পাখির উড়াল হতে।

শুধু নিজের জন্য আমি তোকে চাইনি কখনো,
তা আমি চাইবোও না। কেবল ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাতে
যে আলো উছলে পড়ে দিক-বিদিক, সে আলো
সারা মুখে মেখে একা ছাদে
তুই যখন গান ধরিস,
সেটা যে আমার পছন্দের রবীন্দ্রনাথের গানই হতে হবে
এমন বিলাসিতা আমার একদমই নেই।
আমি চেয়েছিলাম অপার্থিব সেই আলোয়
তুই কেমন মায়াবী তা দেখতে।

শুধু ঘরকন্নার জন্য হলে তো আমি কতজনকেই পাই!
সব ঘরকন্নাকে চুলোয় যেতে দিয়ে এক মগ চা হাতে
বৃষ্টি দেখার জন্য আমি ক’জনকেই বা পাই! শহুরে
বৃষ্টির দিনে, ইলেকট্রিক লাইনে বসে থেকে থেকে,
বোকার মতো ভিজতে ভিজতে,
জবুথবু হয়ে যায় যে কাক,
যাকে দেখে জীবনে প্রথম বারের মতো মনে হয়, হয়তো
কাক হলে বেশ হতো, তোকে নিয়ে ঠিক সে রকম
শহরের রাস্তায় চেয়েছিলাম
কাকভেজা হতে।

চেয়েছিলাম, যেন হই শুধু তুই আর আমি; আমি আর তুই।
আর যেন পাই কয়েকটি নীল ময়ুরের যৌবন।

স্মৃতিময় শহরের রূপকথারা

old-city-painting-rybakow-135-0

আমার স্মৃতিময় শহর;
আমার স্বপ্নালু চোখে এঁকে দিয়ে গেছে
কত শত স্বপ্নের আঁকিবুঁকি।
কত কত পাওয়া, না পাওয়ার উপকাহিনী।
বহুকাল ধরে ঐ চিলেকোঠার ধুলোজমা দেরাজে
পড়ে আছে ছেঁড়া ঘুড়ি, নাটাইয়ের জীর্ণ সুতো।
সেখানে এখনো স্বেচ্ছায় বন্দী
আমার কৈশোর।
তাকে তবে সেখানেই থাকতে দাও।

শাদা-শরত আকাশের নিচে,
ছাদের রেলিং ধরে হাঁটতে হাঁটতে
বেড়ে উঠেছে আমার চিন্তারা।
হয়তো সেখানে এখনো হাঁটছে তারা,
কোন এক চৈতালি ভরা জোছনায়।

নিঃসঙ্গ রাখালের বাঁশির মতো
গুমরে গুমরে কাঁদছে আমার ফেলে আসা
ভালোবাসা, বাতাসে উড়তে থাকা তার চুল,
গোলাপি ওড়না। উদাসী বিকেল আর
হিরণ্ময় দুপুরের মায়ায়
বাকিটা জীবন সেখানেই থাকুক তারা।

বিশ্বদা’র দোকানে এখনো লুকিয়ে
আছে আমার স্কুল ফাঁকির ঘণ্টাগুলো,
সিগারেটের ফিল্টারে প্রথম টান,
লাল চোখ আর দমকা কাশি।
অপরাধী’র মতন মুখ করে
সেখানেই লুকিয়ে থাকতে চায় তারা।
তবে তারা সেখানেই থাকুক, তারপর
নিমেষেই ভুলে যাক আর সব।
সিক্ত নীলাম্বরীর মতো ভিজে সারা
হোক অঝোর শ্রাবণে।

ইচ্ছেঘুড়ি

dieu3

আমি দেখি ফুল
গন্ধে আকুল।
বিলাবে সে কাকে?
জানলার ফাঁকে।

আমি গুনি হাঁস
বাউলা বাতাস (পুকুরে)
ভিজে তার ডানা
আবার ভিজেনা।

আমি মেলি পাখা
চালতার শাখা।
সবুজ আর সাদা
সোহাগে মাখামাখা।

আমি শুনি ভুল
রাঙা বুলবুল।
ডেকে যায় দু’টি, নিবিড়ে
বসে কাছাকাছি।

কল্পনাগুলো অলীক নয়

soma007_1258516464_5-Indian_Pond_Heron__Ardeola_grayii__22-Mar-2007_10-17-49_AM

চোখ বন্ধ করলেই
আমি দেখি-
একটি কানিবক; যে
মধ্যআকাশ থেকে হঠাৎ
আনত নেমে আসে
একটা পানাপড়া
মধ্যপুকুরে।

তার ছাইরঙা পালকগুলোর
অবশিষ্ট একটি-দু’টি
ভেসে থাকে পুকুরের
স্থির পানিতে।
আর-
তার গুলিবিদ্ধ,
রক্তাক্ত, প্রাণহীন, নিথর
দেহটা ধরা থাকে
পাষণ্ড শিকারির
নিষ্ঠুর হাতে।