দি আউটসাইডার- আলবেয়ার কাম্যু

  • পর্ব- ১

মা মারা গেলেন আজ। অথবা হয়তো গতকাল। আমি ঠিক জানি না। আশ্রম থেকে হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম পেলাম-

‘মা আর নেই। শেষকৃত্য আগামীকাল। আপনার বিশ্বস্ত।’

এ থেকে কিছুই বুঝা যায়না। এটা গতকালও হতে পারে।

বৃদ্ধাশ্রমটি ম্যারেনগোতে; আলজিয়ার্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে। আমি বেলা দুইটার বাস ধরবো এবং  তারপর ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল। তারপর রাতের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আগামীকাল রাতের মধ্যেই আমি ফিরে আসতে পারবো। আমি বসকে দু’দিনের ছুটির জন্য বলেছিলাম। উপযুক্ত কারণ থাকায় তিনি না করতে পারেননি। অবশ্য তাঁকে খুব একটা সন্তুষ্টও মনে হয়নি। আমি তাঁকে বললাম, ‘এটা আমার কোন গলদ নয়।’ তিনি কোন উত্তর দেননি। এরপর আমার মনে হল যে, আমি তাঁকে এটা না বললেও পারতাম। এখানে অপরাধবোধ দেখানো আমার সাজে না। উল্টো তাঁরই এখন আমাকে সান্ত্বনা দেবার কথা। ভাবলাম, আগামী পরশু হয়তো সে এটা করবে যখন আমাকে শোকাহত দেখবে। এই মুহূর্তে এটা মনে হতে পারে যে, মা হয়তো এখনো জীবিত। যদিও শেষকৃত্যের পর মৃত্যুটা হয়ে উঠবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পূর্ণ জিনিসটাই একটা লোকদেখানো আবহে পরিণত হবে।

দি আউটসাইডার
আলবেয়ার কাম্যু
প্রকাশকালঃ ১৯৪২

আমি বেলা দুইটার বাস ধরলাম। বাইরে খুব গরম ছিল। বরাবরের মতো সিলেস্তার রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সারলাম। সেখানের সবাই আমার জন্য দুঃখিত হল। বিশেষ করে সিলেস্তা আমাকে বললো, ‘মায়ের মতোন আর কেউ হয় না।’ বেরিয়ে আসার সময় তারা আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। আমার খানিকটা তাড়া ছিল। কেননা, ইমানুয়েলের ওখানে আমাকে যেতে হতো; একটা কালো টাই  আর আর্মব্যান্ড ধার করার জন্য। তার কাছে হয়তো ওগুলো থাকবে। কারণ, মাস কয়েক আগে সে তার চাচাকে হারায়।

বাসের জন্য আমাকে দৌড়াতে হল। এতো সবকিছুর একসাথে মাথার উপর চেপে থাকা এবং তারপর এই হুড়োহুড়ি, পেট্রোলের গন্ধ এবং রাস্তায় কটমট করে তাকানো সূর্যের আলোর তির্যক প্রতিফলন আমাকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল। প্রায় সবটুকু রাস্তা আমি ঘুমিয়ে কাটালাম। যখন ঘুম ভাঙল, তখন বুঝলাম আমি এক সৈনিকের দিকে ঢলে পড়েছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। জানতে চাইলো, আমি আমার গন্তব্য পেছনে ফেলে এসেছি কি না। তাকে এড়াবার জন্য আমি একটা শুকনো ‘হ্যাঁ’ বলে বাস থেকে নেমে পড়লাম।

আলবেয়ার কাম্যু

আলবেয়ার কাম্যু (১৯১৩-১৯৬০)

আশ্রমটি গ্রাম থেকে আরও মাইল খানেক দূরে। পুরোটা পথ আমি হাঁটলাম। আমি চেয়েছিলাম সরাসরি মাকে দেখতে।  কিন্তু কেয়ারটেকার আমাকে জানালো যে, আমাকে আগে ওয়ার্ডেনের সাথে দেখা করতে হবে। তিনি ব্যস্ত থাকায় আমাকে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। কেয়ারটেকার এই পুরোটা সময় কথা বলেই গেল। তারপর একসময় সে আমাকে ওয়ার্ডেনের অফিসটা দেখিয়ে দিলো।

ওয়ার্ডেন ছোটখাটো বয়স্ক মানুষ; সম্মান ও মর্যাদার একটা দীপ্তি তাঁর চোখে আর মুখে। তিনি তাঁর উজ্জ্বল চোখ মেলে আমাকে দেখলেন। তারপর আমার দিকে হাত বাড়ালেন এবং হাতটা ধরে থাকলেন অনেকটা সময়। যখন আমি ভাবছিলাম, কি করে হাতটা ছাড়ানো যায়, তখনি তিনি আমার হাতটা ছাড়লেন। তিনি একটা ফাইল খুলে আমাকে বললেন, ‘মিসেস মার্সেল এখানে এসেছিলেন বছর তিনেক আগে। তুমিই ছিলে তাঁর একমাত্র অবলম্বন।’ আমার কাছে মনে হল যেন তিনি আমাকে ইংগিতপূর্ণ কিছু বলতে চলেছেন। তাই আমি আগ বাড়িয়ে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলাম। তিনি আমাকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘তোমার নিজেকে সংশোধনের কোন প্রয়োজন নেই, বৎস। তোমার মায়ের নথিগুলো আমি পড়েছি। তোমার পক্ষে তাঁর দেখভাল ঠিকঠাকভাবে করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাঁর একজন নার্সের  বড় প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তোমার উপার্জন ছিল যৎসামান্য। এবং সবকিছু বিবেচনা করলে তিনি এখানে ভালোই ছিলেন।’ আমি বললাম, ‘জ্বি, স্যার।’ তারপর তিনি বললেন, ‘দ্যাখো, তিনি এখানে তাঁর মতন আরও বয়স্কদের সাথেই ছিলেন। তিনি তাঁদের সাথে তাঁর পছন্দ-অপছন্দগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারতেন। তুমি হলে গিয়ে তরুণ; সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রজন্ম। তোমার সাথে থাকলে তিনি নিশ্চয় হাঁপিয়ে উঠতেন।’

সত্যিই তাই। যখন বাড়িতে ছিলেন, নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে থাকাতেই মা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে শুরু করার দিনগুলোতে তিনি অনেক কাঁদতেন। এর এক কি দুই মাস পরে তিনি কাঁদতেন, যদি তাঁকে আশ্রমের বাইরে কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো। কারণ, তখন  এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেকটা এই কারণেই আমি গত এক বছরে কালে-ভদ্রে গিয়েছি তাঁকে দেখতে। তাছাড়া এখানে আসার অর্থ ছিল আমার রোববার-টাকে পুরোপুরি জলে ফেলা; এমনকি বাসস্টপে যাওয়ার চেষ্টা করা, টিকিট কেনা আর দুইটা ঘণ্টা বাসে বসে নষ্ট করা।

ওয়ার্ডেন আমাকে আবার কিছু বলছিলেন। আমি সত্যিকার অর্থেই আর কিছু শুনছিলাম না। শেষে তিনি বললেন, ‘আশা করি এবার তুমি তোমার মাকে দেখবে।’ আমি কোন কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম। তাঁর পিছু পিছু দরজার দিকে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় তিনি ব্যাখ্যার মতো করে বললেন, ‘আমরা তাঁকে আমাদের ছোট্ট মর্গে স্থানান্তর করেছি। যাতে কাউকে বিমর্ষ না হতে হয়। প্রতিবারই যখন আশ্রমের কেউ মারা যান, অন্যরা দুই কি তিন দিন অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন। এটা এই আশ্রমের কর্মচারীদের কাজটাকে একটু কঠিনই করে দেয়।’ আমরা একটা উঠোনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানটা জুড়ে অনেক বয়স্ক লোকজন। তারা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কথা-বার্তা বলছিল নিজেদের মধ্যে। আমাদের যেতে দেখে তাঁদের কথা বলা থেমে গেল। আমরা যখন জটলাটা পেছনে ফেললাম, তখনি আবার তাঁদের গুঞ্জন শুনতে পেলাম। তাদের গুঞ্জনটা মনে হচ্ছিল যেন টিয়া পাখির বোবা কিচিরমিচিরের মতো। একটা ছোট্ট দালানের দরজার সামনে এসে ওয়ার্ডেন থামলেন। বললেন, ‘আমি এখন যাবো, মি. মার্সেল। যদি কোন কিছুর জন্য আমাকে দরকার হয়, আমি অফিসেই আছি। বরাবরের মতো সকাল দশটায় আমরা শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছি। আমরা মনে করি, এতে করে তুমি আজ রাতে পরলোকগতাকে বহুক্ষণ দেখার সুযোগ পাবে। আর একটা কথা-  তোমার মা তাঁর বন্ধু-বান্ধবদের কাছে একটা ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ শেষকৃত্যের ইচ্ছেই ব্যক্ত করেছিলেন। প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা আমিই করছি। কিন্তু এটা তোমাকে আমার জানানো উচিত বলে আমি মনে করছি।’ আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম। যদিও মা নাস্তিক ছিলেন না, তবুও তাঁকে জীবনে কখনো ধর্ম পালন করতে আমি দেখিনি।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। ঘরটা বেশ উজ্জ্বল; দেওয়ালে সাদা চুনকাম করা। ছাদটা কাঁচের। ঘরটায় আসবাব বলতে কেবল কয়েকটা চেয়ার আর কিছু আড়াআড়ি কাঠের টুকরা। এর মধ্যে দুটো আছে ঘরের মাঝখানে; একটা কফিনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো। কফিনটার ডালা খোলা; ডালাটার ওপর চকচকে স্ক্রুগুলো আলগা বের হয়ে আছে। কফিনের ঠিক পাশেই একজন আরব নার্স। তার সারা শরীর সাদা পোশাকে ঢাকা আর মাথায় একটা স্কার্ফ; সেটার রঙ খুব উজ্জ্বল। (চলমান)