নাম শুনে এদেশি মনে হলেও বাগান বিলাস মূলত বিদেশি ফুল। নামের মতোই দেখতেও অনিন্দ্য সুন্দর এই ফুল। এর ইংরেজি নাম ‘Bougainvillea’।
Kingdom: Plantae
Phylum: Angiosperms
Class: Eudicots
Order: Caryophyllales
Family: Nyctaginaceae
Genus: Bougainvillea
Species: B. Spectabilis
দক্ষিন আমেরিকার ব্রাজিল, পেরু, আর্জেন্টিনা এই দেশগুলোকে আমাদের বাগান বিলাসের আদি নিবাস বলে ভাবা হয়। এই দেশে যখন প্রথম আনা হয়, তখন কেবলমাত্র আমাদের অভিজাত শ্রেণীর লোকদের বাড়িতেই শোভা পেত এই ফুল। পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণপ্রিয় আমাদের তখনকার ঐ অভিজাত শ্রেণী অন্যদের কাছে এই ফুলকে পরিচয় করিয়ে দিতেন ‘বোগেনভিলা’ নামে। ‘বোগেনভিলা’ থেকে ‘বাগান বিলাস’; নামের এই বিবর্তনের মূল কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথের।
এ নিয়ে কিংবদন্তি আছে এইরকম-
সেই সময়ের কোন এক অভিজাত, বিলাসী লোকের বাড়ির বাগানে রবি ঠাকুর প্রথম দেখেন এই ফুল । অপূর্ব এই ফুলের রঙ ও রূপে কবি যারপরনাই মুগ্ধ হন। তিনি কৌতূহলে এর নাম জানতে চান। অপরূপ সুন্দর এই ফুলের বিদেশি নাম শুনে কবি কিছুটা নাখোশ হন। তখন তিনি এর নাম দেন ‘বাগান বিলাস’।
‘বিলাসী বা বাগান বিলাসী’ লোকের বাগানে প্রথম দেখেন বলেই হয়তো রবি ঠাকুর দিয়েছিলেন এমন নাম। সেই থেকে বিদেশি ফুল ‘বোগেনভিলা’ হয়ে গেল আমাদের নিজস্ব ফুল ‘বাগান বিলাস’। বাংলাদেশের মাটি,জলবায়ু আর মানুষের সাথে বাগান বিলাস এমনভাবে মিশে গেছে যে, এখন এই সময়ে এসে এই ফুলকে দেখলে কোনকালে যে এটা বিদেশি ফুল ছিল বা দেশী ফুল ভিন্ন কিছু ছিল তেমনটা আর মনে হয় না।
লম্বায় এই গাছ ১-১২ মিটার পর্যন্ত হয়। এটা নির্ভর করে গাছটি কত উঁচু অবলম্বন ধরে বেড়ে উঠছে সম্পূর্ণ তার উপর। বাগান বিলাস কাঁটাযুক্ত গাছ; এর কাঁটাগুলো ভালোই তীক্ষ্ণ। বাগান বিলাসের এতো কদর মূলত এর ফুলের কারণেই। ফুলগুলোর একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব থাকে খুব কম; অর্থাৎ এরা থাকে খুব ঘন। প্রতিটি ফুলে তিনটি পাপড়ি তিন দিক থেকে একে অপরকে ঘিরে থাকে। ফলে, আলাদাভাবে ফুলগুলোকে লাগে অনেকটা কাঁঠাল পাতা দিয়ে বানানো ঠোঙার মতো। এর ভিতরে থাকে পুংকেশর, স্ত্রীকেশর ইত্যাদি।
পৃথিবী ব্যাপি বাগান বিলাসের ১৮টি পর্যন্ত প্রজাতির সন্ধান মেলে। বাংলাদেশে আছে এর তিনটি প্রজাতি। লাল, হলুদ আর সাদা।
আমাদের নাগরিক জীবনে এক ঝলক স্নিগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিতে বাগান বিলাসের জুড়ি নেই। আপনি হয়তো রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, তখন দেখলেন কোন বাড়ির গেইটের উপর থেকে ঝুলে আছে লাল বাগান বিলাসের ঝোঁপ। আপনার পথচলার সব ক্লান্তি নিমেষেই দূর হয়ে যাবে তাতে।
অথবা ধরা যাক, আপনি মগবাজার মোড় থেকে রিকশায় করে যাচ্ছেন বেইলি রোডের দিকে। গ্রীষ্মের রাস্তায় অসহ্য জ্যামে আপনি স্বভাবতই বিরক্ত। ঘামে ভেজা কপাল আর চোখ কুঁচকে হঠাৎই তাকালেন আপনার ডান দিকে। আপনার চোখ চলে যাবে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মা’র সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে একটু ভেতরে এবং ওখান থেকে আরও ভেতরে দোতলার ব্যালকনিতে। যতোদূর তাকাবেন শুধু দেখা যাবে লাল লাল বাগান বিলাসের ঝোঁপ। মুহূর্তেই সব বিরক্তি কর্পূরের মতন উবে গিয়ে আপনার মন ভরে উঠবে আশ্চর্য প্রশান্তিতে।
প্রকৃতিবিদগণ বাগান বিলাসকে ‘অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট’ বা ‘শোভাবর্ধক উদ্ভিদ’ হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন। এর কোন ভেষজ গুণের কথা আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। তবে এর ছাল থেকে বেরুনো রস ‘স্কিন র্যাশ’ সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
শহরে তো দেখতে পাবেনই,আবার শহর থেকে দূরে কোন গ্রামীণ জনপদে বেড়াতে এলে বাগান বিলাস দেখে খুব অবাক হবেন না যেন! বরং শহরের ইট-কাঠ-পাথরের জীবন থেকে গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধময় জীবনেই বাগান বিলাস যেন আরও অনেক বেশি সপ্রতিভ। অবশ্য সেখানে কেউ একে ‘বাগান বিলাস’ বলে চিনে না। বাগান বিলাস সেখানে বেশি পরিচিত ‘গেইট ফুল’ নামে। বাড়ির গেইট বা সদর দরজায় বেশি মানানসই বলেই হয়তো তারা একে এই নামেই ডাকে।
আবার, এর পাপড়িগুলো খুব পাতলা আর রঙিন কাগজের মতো দেখতে বলে কোথাও কোথাও এটি পরিচিত ‘কাগজি ফুল’ নামেও। যেখানে যে নামেই ডাকা হোক না কেন নিসর্গপ্রেমীদের কাছে এর আবেদন সর্বজনীন।