ইরানি চলচ্চিত্র নিয়ে আমার প্রত্যাশা ও উচ্ছ্বাস বরাবরই বেশ বাড়াবাড়ি। মাজিদ মাজিদির ‘Children of Heaven’ দেখা থেকে শুরু। এতো কম চলচ্চিত্রকে পুঁজি করে বিশ্ব চলচ্চিত্রে ইতিবাচক সাড়া ফেলতে পারার নজির সম্ভবত ইরান ছাড়া আর কেউ দেখাতে পারেনি। রোমান্টিসিজম বা যৌন সুঁড়সুঁড়ি দিয়ে নয়; শুধুমাত্র মানব-মনের ভাবাবেগ আর জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে জনপ্রিয়তায় এমনভাবে এগুতে পারেনি আর কোন দেশের সিনেমা। আরব দেশগুলোতে ধর্মকেই জীবনের সবকিছু ভাবা হয়ে থাকে। ইরানি চলচ্চিত্রকারেরা তাঁদের সিনেমায় ধর্ম নিয়ে কোথাও কোন অবহেলা দেখান নি; আবার কোথাও ধর্মকে খুব বেশি গুরুত্বও দেন নি। ইরানি চলচ্চিত্রের এইদিকটিও বিশেষ লক্ষণীয়।
মাজিদ মাজিদি, জাফর পানাহি, আব্বাস কিয়রুস্তামি ইরানি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয়তার ধারক ও বাহক। এক্ষেত্রে সবশেষ সংযুক্তি আসগর ফারহাদি। আসগর ফারহাদির এর আগে বানানো চারটি চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘About Elly’ নামে একটি বিপুল দর্শকনন্দিত চলচ্চিত্রও আছে। সেটি মুক্তি পায় ২০০৯ সালে এবং লাভ করে ‘বার্লিন চলচ্চিত্র পুরস্কার’। তাঁর সবশেষ সাড়াজাগানো চলচ্চিত্র A Separation. নামটি শুনেই মনে হতে পারে হয়তো বিচ্ছেদই এই চলচ্চিত্রের মূল সুর। প্রথম যখন চলচ্চিত্রটির নাম শুনেছিলাম তখন অন্তত আমার ভেতর এই ভাবনাটুকুই স্থান পেয়েছিল। যখন পুরোটা শেষ করলাম তখন দেখলাম আমার প্রারম্ভিক ভাবনা অমূলক ছিল না কিছুতেই। যদিও মাঝখানের কিছু ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ ইতিবাচক একটি পরিণতিরই আভাস দিচ্ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। তা হলেই হয়তো খুশি হতাম সবথেকে বেশি। অদৃষ্টবাদীরা হয়তো বলবেন নিয়তি বলে তো একটা কথা আছে! নাকি? কিন্তু আমি বলবো, কাহিনির চূড়ান্ত পরিনতি এটাই ছিল। কারণ কী? কারণ, ধর্মেই বলা আছে- মানুষ যতক্ষণ না নিজেকে সাহায্য করে, স্রষ্টাও ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে সাহায্য করেন না।
বাহ্যিকভাবে দেখলে, নাদের থেকে সিমিনের বিচ্ছেদের কাহিনী এটা। কিন্তু এটাই চলচ্চিত্রটির শেষ কথা নয়। বরং আমার কাছে এটাকে অন্য অনেক কিছু বলবার জন্য নিছক একটা অজুহাত বলেই মনে হয়। কেননা, এই বিচ্ছেদই অন্যান্য অনেক ঘটনা- দুর্ঘটনা, চরিত্রগুলোর অন্তর্জগত-বহির্জগত ও জটিল মনস্তত্ত্বকে আমাদের সামনে নিয়ে আসার সুযোগ পাইয়ে দেয়।
এই চলচ্চিত্রটি আমাদের যে জগতের খোঁজ মিলিয়ে দেয়, সেটি আমাদের কাছে খানিকটা অচেনা হলেও পুরোপুরি অচেনা নয়। জটিল সেই জগতের পটভূমি উন্মোচিত ইরানের রাজধানী তেহরানের এক তথাকথিত সু-শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিমণ্ডলে। সেখানকার মানুষগুলোও ঠিক আমাদের মতো সমস্যা আর প্রশ্ন নিয়ে প্রতিনিয়ত হাজির হয় জীবনের জানালায়। অপেক্ষায় থাকে প্রশান্তির সুবাতাসের জন্য। কিন্তু আস্তে আস্তে, একটু থেকে আরেকটু, যেমন কেবল একটা ফোঁটা পলে পলে মহাপ্লাবনের রূপ নেয়, নিতান্ত সাধারণ থেকে হয়ে উঠে প্রলয়ঙ্করী, নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য; ঠিক তেমনি নিত্যকার ছোটখাটো মান-অভিমান, ভুল বোঝাবুঝি, সন্দেহ ইত্যাদি এরকম সবকিছু একটা ক্ষুদ্র, নগণ্য গুটি থেকে ধীরে ধীরে একটা দৈত্যের সুরত ধারণ করে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে দেয় সবাইকেই এবং সবকিছুকেই।
- চলচ্চিত্র কুশীলববৃন্দঃ
- লেইলা হাতামি__সিমিন
- পেয়মান মোয়াদি__নাদের
- শাহাব হোসেইনি__হুদজাত
- সারেহ বায়াত__রাজিয়েহ
- সারিনা ফারহাদি__তেরমেহ
- আলি-আসগর শাহবাযি__নাদেরের বাবা
- শিরিন ইয়াসদানবকশ__সিমিনের মা
- কিমিন হোসেইনি__সোমায়েহ
- মেরিলা যারেই__মিসেস ঘাহরেই
- কাহিনী পরম্পরা
একদম শুরুর আগেও যে শুরু থাকে, তাতে একজনকে আমরা জেরক্স মেশিনে ফটোকপি করছে, এমন অবস্থায় আবিষ্কার করি। তখন না বুঝলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারি সিমিন ও নাদের ছাড়াও আরও ছয় ইরানি দম্পতির পরিচয়পত্র ফটোকপি করছে সে এবং তাঁরা সকলেই বিবাহ বিচ্ছেদ প্রার্থী। তারপরেই পরিচালক আমাদের একটি কক্ষে নিয়ে যান যেখানে আমরা দেখতে পাই আমাদের প্রধান দুই চরিত্র নাদের ও সিমিন পাশাপাশি বসে আছে। একজন লোক সিমিনকে উদ্দেশ্য করে বলছেন- আপনি যা বলছেন বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য শুধুমাত্র এই কারণগুলোই যথেষ্ট নয়। আপনার যদি অন্য কোন কারণ থাকে, তো বলুন।
সত্যিই যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ আছে কি! একদমই না। সিমিন নিজেও তা জানে। তাঁর সামনে আছে ইরান ছেড়েছুঁড়ে, স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় যাওয়ার হাতছানি। সেখানে সে তাঁর দশ পেরিয়ে এগারোয় পড়তে যাওয়া কিশোরী মেয়ে তেরমেহ-কে দিতে চায় এক উন্নততর জীবনের নিশ্চয়তা। কিন্তু, নাদের অপারগ। সে এখানেই থাকবে ‘আলজেইমার’ নামক অসুখে আক্রান্ত তাঁর বাবার সাথে। সিমিনও নাছোড়বান্দা। সে অনেকটা রেগেই তাঁর স্বামীকে বলে- তিনি এমনকি জানেনও না যে, তুমি তাঁর ছেলে! নাদের তখন একজন পুত্রের উপযুক্ত জবাবই দেয়। বলে, কিন্তু, আমি তো জানি যে, তিনি আমার বাবা! আলজেইমার নামক ব্যাধিতে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে নাদেরের সংগ্রামের কিছু স্থিরচিত্র কিন্তু, পারষ্পরিক ঐক্যমতের অভাবে কোন উপসংহারেই তাঁরা পৌঁছতে পারে না। বিধ্বস্ত সিমিন পারিবারিক অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে অনেকটা অভিমানেই বাপের বাড়িতে চলে যায়। পেছনে পড়ে থাকে তেরমেহ, নাদের, নাদেরের বাবা- তাঁর শ্বশুর আর তাঁর চৌদ্দ বছরের সংসার। নাদের তাঁকে বাধা দেয়ার বা ফেরানোর জন্য কোন কিছুই করে না। কিন্তু, সবসময় আশায় আশায় থাকে সিমিন ফিরে আসবে! এদিকে সংসারের কাজগুলো করার জন্য, বাবার যত্ন নেয়ার জন্য তো কাউকে দরকার! রাজিয়েহ নামে একজন অসম্ভব সৎ আর ধার্মিক মহিলাকে এই কাজের জন্য ঠিক করে নাদের; অবশ্য অনেকটা কম পারিশ্রমিকেই। কাজ করতে এসেই গর্ভবতী রাজিয়েহ বুঝতে পারে যে, সে কতটা কঠিন অবস্থায় নিজেকে ফেলেছে। নাদেরের বাবা এতোটাই অসুস্থ যে নিজের কাপড় পাল্টাতেও তিনি অক্ষম। নিরুপায় হয়ে রাজিয়েহ টেলিফোনে জীবনঘনিষ্ঠ সমস্যার শুদ্ধ ইসলামিক সমাধান দেয় এমন এক ইমামকে জিজ্ঞেস করে, আমি এই বাড়িতে এসেছি কাজ করতে। আমাকে একজন বয়স্ক লোকের দেখভাল করতে হয়। আমি জানতে চাই, মাফ করবেন! কিন্তু উনি তাঁর প্যান্টে প্রস্রাব করেছেন। এখন আমার জিজ্ঞাসা- যদি তাঁর পোশাক পাল্টে দেই, এটা কি পাপ হবে? নাকি হবে না?
এই পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে চলতে গিয়ে ক্লান্ত রাজিয়েহ, মালিককে তার কাজ করতে না আসার কথা বলে, তার জায়গায় তাঁর ঋণের দায়ে জর্জরিত মাথা গরম, বেকার স্বামী হোদজাতের কাজের প্রস্তাব দেয়। নাদের একসময় রাজিও হয়। কিন্তু, বিধি বাম! হোদজাতকে সুদী মহাজনদের তৎপরতায় পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। ফলে, রাজিয়েহকে ফিরতেই হয়। আর তারপর থেকেই সবকিছু কেমন যেন ভুলের দিকে যেতে থাকে এবং চরিত্রগুলোও তাদের খোলস ছেড়ে বেরুতে থাকে একের পর এক।