অপুর পাঁচালি: অপুর নির্মানকথন

বাংলা সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের অবদানের কথা বলে চর্বিতচর্বন করার কোন মানে হয় না। সত্যজিৎ রায় কতো বড় চলচ্চিত্রকার ছিলেন, কিংবা তাঁর হাতে বাংলা সিনেমা কতটা মহৎ শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠতে পেরেছে সেসব প্রশ্নও আজ অবান্তর। সত্যজিৎ রায় আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের দিকপাল; হয়ে আছেন অবশ্য এখনো।

IMG_20150124_123713

Apu’r Panchali, translated from My Years with Apu written by Satyajit Ray

১৯৫২ সালের শরৎকালের এক বিকেলবেলায়, দীর্ঘ শাদা কাশফুলে ছাওয়া এক মাঠের মধ্যে তিনি শুরু করেছিলেন ‘পথের পাঁচালি’-র শুটিং। যে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থায় তিনি কাজ করতেন, সেখানে ছিল তাঁর পাকা চাকরি। সে চাকরি ছেড়ে তিনি যে সিনেমা বানাতে লেগে গেলেন, সেটার একমাত্র কারণ ছিল শিল্পের প্রতি তাঁর দায়বোধ।

এতো সফল চলচ্চিত্রকার হয়েও ব্যক্তি সত্যজিৎ সবসময়ই থেকে গেছেন অনেকটা অপঠিত। ‘অপুর পাঁচালি’-তে সত্যজিৎ রায় বলে গেছেন তাঁর নিজের জীবনের কথা, চলচ্চিত্র নিয়ে তাঁর নিজস্ব দর্শনের কথা, ‘অপু ট্রিলজি’ নিয়ে তাঁর নিজস্ব ধ্যান-ধারণা আর অভিজ্ঞতার কথা এবং এমনি আরও বিবিধ।

‘অপুর পাঁচালি’ লেখকের ইংরেজিতে লেখা স্মৃতিকথা ‘My Years with Apu’ এর বাংলা অনুবাদ। কেমন করে, কতখানি বাধা-বিপত্তি ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যে তিনি সার্থকতায় পৌঁছেছিলেন তার নেপথ্য-কাহিনী ‘অপুর পাঁচালি’।


  • অপুর পাঁচালি
  • সত্যজিৎ রায়
  • প্রকাশকঃ নওরোজ কিতাবিস্তান
  • প্রথম বাংলাদেশ সংস্করণঃ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭

আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুঃ একটি স্বগত সত্যভাষণ

আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু
শহীদুল জহির
প্রকাশকঃ মাওলা ব্রাদার্স
প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের মৃত্যুর কিছুকাল পরই বই আকারে বের হয় ‘আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু’। তার পরপরই এটি লাভ করে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ’-এর পুরষ্কার। আর তা না হলে চমৎকার এই বইটির খোঁজ পাওয়া এবং কিনে পড়া আমার আদৌ হতো না। এই উপন্যাসের যে স্টাইল তা শহীদুল জহিরের একান্ত নিজস্ব এবং বইটার পাঠকপ্রিয়তার অন্যতম কারণও নিঃসন্দেহে এটিই।

আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু

আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু

উপন্যাসের শুরুটাও এমনি অভিনব……

“সিরাজগঞ্জ শহরের কালিবাড়ি রোডে, মমতাদের বাড়ির প্রাঙ্গণে, পেয়ারা গাছতলায় শববাহকেরা যখন আবু ইব্রাহীমের লাশসহ খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয় এবং প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে জুমা মসজিদের দিকে যেতে থাকে তখন আবু ইব্রাহীমের পৃথুলা বিধবা স্ত্রী মমতার এই শোক এবং নির্মম বাস্তবতার ভেতর বহুদিন পূর্বের এক রাত্রির কথা মনে পড়ে। সেদিন গভীর রাতে ঢাকার বেইলি রোডের সরকারি কলোনিতে আবু ইব্রাহীম মমতাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ব্যালকনিতে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, ‘সারস পাখির ঝাঁক যাইতাসে, শোন।’
কালিবাড়ি সড়কের উপর দিয়ে যখন শববাহক এবং অনুগমনকারীরা উচ্চস্বরে কলেমা তৈয়বা পড়তে পড়তে অগ্রসর হয় তখন মমতার কেন যেন সেই রাতটির কথা মনে পড়ে যায় এবং তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়; বর্ষার যমুনার মতো তার দুচোখ ভেসে যায়। আর সেই রাতে, যে রাতে বেইলি রোডের উপর দিয়ে সারস উড়ে গিয়েছিল, ঘুমের উষ্ণ আরামবঞ্চিত মমতা ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং একটি বাক্য উচ্চারণ করেছিল, যে বাক্যটি এরপর আমরা বহুবার মমতার মুখে উচ্চারিত হতে শুনব এবং পরিনামে আমাদের হয়তো এ রকম মনে হবে যে, মমতা আবু ইব্রাহীমকে যে নামে অভিহিত করেছিল, সে বস্তুত তাই ছিল……………।”

বইটি পড়তে গেলে এই ব্যাপারটি আমাদের প্রায়ই মনে হবে যে, আবু ইব্রাহীম আদতে একজন অসুখী লোক ছিল। কিন্তু তাকে যখন আমরা উদ্ভাসিত হাসি অথবা পত্নী প্রণয়ের ভেতর দেখবো তখন মনে হবে যে, আমাদের সিদ্ধান্তটি হয়তো শেষ সত্য নয়। একটি ব্যর্থ প্রণয়ের বিষণ্ণতা এবং যৌবনে লালিত রাজনৈতিক আদর্শ অর্জনের পথ থেকে সরে আসার গ্লানিবোধ তার ছিল। হেলেন নামের এক মেয়েকে সে ভালবেসেছিল……………

ব্যর্থ প্রেমের কাঙালপনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সে ছ’বছর ঘুরে বেরিয়েছিল। আর তার বহুদিন পর বিবাহিত জীবনে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত আবু ইব্রাহীমের মনে হয় যে, হেলেনকে ছাড়া সে মরে যায়নি!!!

হঠাৎ অতীত প্রেমিকার আগমন, চলমান সংসার ও সম্মুখ স্বপ্নের মধ্যে আকস্মিক মৃত্যু আসে; আর তখনি সত্য হয়ে ওঠে এই উপন্যাসের অমর সত্যদর্শন- মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বালিহাঁসের পালকের চেয়েও হালকা।

উপন্যাসটির শেষের দেড় পৃষ্ঠা চলে এভাবে…………
”এভাবে হাঁসের পালক খসে পড়ার চাইতেও হালকা এবং তুচ্ছ এক মৃত্যু আবু ইব্রাহীমকে গ্রাস করে এবং তাকে নিয়ে সঙ্গতকারণেই আমাদের আর কোন আগ্রহ থাকে না; তাকে আমরা বিস্মৃত হই। শুধু মনে হয় যেন তার পৃথুলা স্ত্রী মমতা তাকে ত্যাগ করতে পারে না। সিরাজগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে হোসেনপুর গোরস্থানে আবু ইব্রাহীমের কবর সবুজ ঘাসে ছেয়ে যায়, কবরের চারদিকে লাগানো মাদারগাছে বৃষ্টির দিনে লাল থোকা থোকা ফুল ফোটে।…………মমতা সারা রাত ধরে কাঁদার তিনদিন পর শেফালির বড় ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায় এবং বিয়ের পরদিনই শেফালির বড় ভাই আব্দুল হাকিম তার কর্মস্থল খুলনা রওনা হয়। মমতা চোখ মুছে শুভ আর বিন্দুর হাত ধরে ট্রেনে গিয়ে ওঠে, তখন সে দেখে আব্দুল হাকিম আঙুলের স্পর্শে বিন্দুর চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে। ঝমাঝম ঝমাঝম করতে করতে একটি কালভার্ট পার হয়ে সিটি বাজিয়ে ট্রেন যখন ছোটে তখন হোসেনপুর গোরস্থানে একটি কুকুর গরুর ফেলে দেওয়া নাড়িভুঁড়ি মুখে করে বয়ে এনে আবু ইব্রাহীমের কবরের অদূরে বসে। প্রথম কুকুরটির পিছন পিছন আসে দ্বিতীয় একটি কুকুর। তারপর গরজন করে উঠে কুকুর দুটি মারামারি শুরু করে; চিৎকার আর হুড়োহুড়িতে চৌচির হয় কবরস্থানের বাতাস। তখন মারামারি করতে করতে একটি কুকুর নাড়িভুঁড়ির টুকরাগুলো মুখে করে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। গোরস্থানে আবার সুষুপ্তির নির্জনতা নামে। সন্ধ্যের বাতাস শীতল এবং প্রসন্ন হয়ে আসে। তখন দূরের দালানকোঠার ভেতর দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ উঠে কড়ই গাছের পাতার ফাঁকে গ্যাস বেলুনের মতো লটকে থাকে এবং একটি পেঁচা উড়ে এসে মাদার গাছের দালে বসে এদিক-ওদিক তাকায়। তারপর পেঁচাটি হঠাৎ উড়ে গিয়ে যখন ঘাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন একটি ছুঁচো তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার করতে করতে আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটে যায়………

কবরস্থানের কবরের কথা আমরা এভাবে ভুলে যাই; সেখানে নির্মেঘ আকাশে চাঁদ হেসে উঠে, ছুঁচোর চিৎকারে বাতাস মুখরিত হয়, সারারাত ধরে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পেঁচা উড়ে।”

চৈনিক দার্শনিকের কথাকে আবু ইব্রাহীমের মতো আমাদেরকেও নিজেদের জীবনের পরম সত্য বলে মেনে নিতে হয়। এছাড়া আর কোন পরিষ্কার পথ আমরা আমাদের সামনে দেখতে পাইনা। এটা হয়তোবা থাই পাহাড়ের চাইতেও ভারী; না হয় বেলে হাঁসের পালকের চাইতেও হালকা।