অরুন, শৈলজা কিংবা একটি জিন্দাবাহার লেন

Once upon a time…

এক ছিল রাজা আর এক ছিল রানী। বহু বছর ধরে তারা সুখে-শান্তিতে বাস করছিল।

রাজা-রানী এখানে মনে হয় ঠিক যুতসই হলো না। এখনকার দিনে বুঝদার পাঠক তো বহুদুর, খুদে বিচ্ছুরাই রাজা-রানির গল্প আর খেতে চায় না! তাই আমার গল্পে রাজা-রানী বাদ থাক। এর থেকে বলা যাক-

এক ছিল ছেলে আর এক ছিল মেয়ে। দিনের পর দিন তারা ছিল ভালো বন্ধু।

রূপকথার রাজা-রানির চেয়ে এ-ই অনেক ভালো! রাজা-রানির কোন নাম না থাকলেও চলে। কিন্তু সাধারণ মানুষের যা হোক একটা নাম থাকা চাই। তাই ছেলেটির নাম অরুন আর মেয়েটির নাম দিলাম শৈলজা। আমাদের এই অরুন আর শৈলজা দিনের পর দিন ছিল ভালো বন্ধু। তাদের একসাথে কাটানো সময়টুকুর বিবরণ জানতে চাইলে আমার ১৩/৮, জিন্দাবাহার লেনের সাদা ক্রিম কালারের বাড়িটায় এসে সব দেখে যেতে পারেন। বলা ভালো, এসে পড়ে যেতে পারেন। এক পশলা প্রবল বর্ষণের পর শরতের মেঘমুক্ত আকাশ যেমন পরিষ্কার, অরুনের পোষা খয়েরিরঙা শালিখের পালকের মতো খয়েরি ডায়েরিটায় তেমনি পরিষ্কার করে লেখা আছে সব।

জিন্দাবাহার লেন! ভারি অদ্ভুত নাম। এবং অদ্ভুতভাবে এটাই এখন আমার ঠিকানা, আমার নিবাস। নিবাস বলতে চিলেকোঠার এই ছোট্ট ঘরটা; যার দরজা পেরোলেই ইয়া বড় ছাদ! ছাদময় ছড়ানো টবে অসংখ্য গাছ। সেগুলোর অধিকাংশেরই নাম জানি না।

এই লেখাগুলোই আপনি দেখতে পাবেন ডায়েরিটার প্রথম পাতায়। গোটা গোটা অক্ষরে নীল কালির কলম দিয়ে লেখা। তারপর যতোই পাতা উল্টাতে থাকবেন, ততোই আপনার কাছে পরিষ্কার হতে থাকবে একে একে। অরুন, শৈলজা, ১৩/৮ জিন্দাবাহার লেন; সব সব।

আমি যেখানটায় থাকি সেই ১৩/৮, জিন্দাবাহার লেনটায় এখন শরতের বিকেল। চিলেকোঠার মরে যাওয়া রোদ, ধনুকের মতো বাঁকা নারকেল গাছটা থেকে সরে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো, সাদা রঙের বাড়িটায়- তার আধখোলা জানলার শার্সিতে, বারবার গোঁত্তা খেয়ে ফিরে আসা মাছিগুলোর রূপোলি ডানায়।এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি দু’চোখ বন্ধ করে। অবশ্য মাঝে মাঝে একচোখ খুলে কায়দা করে দেখে নিচ্ছি যে- শৈলজা আসছে কিনা! শৈলজা’ই আমাকে এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে। যাওয়ার আগে বলে গেছে, ‘খবরদার! চোখ খুলবে না কিন্তু। আমি এখুনি আসছি।’ দুই চোখই বন্ধ রাখবো কিনা যেহেতু নির্দিষ্ট করে বলে যায় নি, সেহেতু মাঝে মাঝে আমি এক চোখ খুলে চারপাশটা দেখে নিচ্ছি। এতে তো দোষের কিছু নেই! অন্তত, আমার লজিক তো তাই বলছে! শৈলজা আসতে যতো দেরি করছে, ততোই ভেতরে ভেতরে আমার একটু একটু করে অস্থির লাগতে শুরু করেছে। শৈলজা এটা জানে! আমার মনে হচ্ছে, শৈলজা ইচ্ছে করেই অমন দেরি করছে!

ইচ্ছে করে দেরি না করলেও সেদিন শেষ পর্যন্ত শৈলজা এসেছিলো। কিন্তু ততক্ষনে অরুনের মনে হবে যেন কতকাল পেরিয়ে গেছে। ধনুকের মতো বাঁকা নারকেল গাছটায় তখন জমাট বাঁধা অন্ধকার। মাছিগুলোর রূপালি ডানায় তখন ভর করেছে গাঢ় নীল বিষাদ!

*

Once we dreamt that we were strangers.
We wake up to find that we were dear to each other.

নতুন বাসায় এসেই নতুন কলের পানিতে গোসল করে ঠাণ্ডা বাঁধিয়ে ফেলেছিল অরুন। ঠাণ্ডায় অবস্থা একেবারে নাজেহাল দেখে, শেষমেশ বিলুদা-ই অরুনের জন্য দু’তলা থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিলো এক বাটি তুলসি পাতার রস। তাতেই নাকি অরুনের ঠাণ্ডার ভাব কমেছিল। তারপর থেকে বিলুদাকে নয়, অনেকবারই আমরা কারণে-অকারনে অরুনকে তুলসি পাতার রস আনতে দু’তলায় শৈলজার কাছে যেতে দেখবো। তখন আমাদের মনে হবে, অরুন হয়তো প্রকৃতপক্ষে তাই ছিল, শৈলজা তাকে ঠিক যা বলত।

সেদিন ছিল রোববার। অরুন তার ডায়েরির এই পৃষ্ঠায় কাকতালীয়ভাবে কোন তারিখ না দিয়ে শুধু বারটাই লিখেছিল। পৃষ্ঠার উপরে একদম ডানদিকে। না। আমি কোন ভুল করছি না। চাইলে নিজেই এসে দেখে যেতে পারেন। এক পশলা প্রবল বর্ষণের পর শরতের মেঘমুক্ত আকাশ যেমন পরিষ্কার…

তখন ক্লাস এইটে পড়ি। আমাদের মফঃস্বলের বাড়িটার পেছন দিকের দেয়ালে একবার কে যেন কয়লা দিয়ে শয়তানি করে লিখে রেখেছিল ‘আনিকা+অরুন’! একদিন ভোরবেলা। পেছনের উঠান থেকে কয়লা আনতে গিয়ে বাবা দেখতে পান লেখাটা। তখনি ঘুম থেকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বাবা আমাকে ফেললেন পেছনের উঠানে। লেখাটা যেখানে লেখা হয়েছিল ঠিক সেখানে। এই আনিকা যে কে, আর তাকে যে আমি সাত জন্মেও চিনি না, এই কথা বাবাকে সেদিন আমি আর বিশ্বাস করাতে পারিনি। কিন্তু আজ খুব ইচ্ছে করছিল, চিলেকোঠার দেয়ালটায় সত্যি সত্যি লিখি অরূপ+শৈলজা । আমাদের মফঃস্বলের বাড়ির পেছনের দেয়ালে কাঠ কয়লা দিয়ে যেমন লেখা ছিল তেমন। শৈলজাকে এই কথা বলতেই সে চোখ কুঁচকে তাকালো। তারপর হেসে বলল, ‘তুমি একটা আস্ত পাগল!’

অরুনকে নিয়ে ঠিক একই কথা আমরা জায়গায় জায়গায় শৈলজাকে বলতে শুনবো। পরদিন সকালবেলায় ছাদের চিলেকোঠার পিছনের দেয়াল ঘেঁষে শৈলজার লাগানো নয়নতারার গোঁড়ায় পানি ঢালতে গিয়ে বিলুদার চোখ গিয়ে পড়বে কাঠ কয়লা দিয়ে লেখা সেই অক্ষরগুলোয়, যেগুলো এর আগে সে ওখানে আর কখনো লেখা দেখতে পায়নি। তখন বিলুদা ভেঙ্গে ভেঙ্গে বানান করে পড়তে চাইবে সেই অক্ষরগুলো। শেষে সেই বোবা অক্ষরগুলো একত্র করে যখন উচ্চারণ করবে বিলুদা আর ফিক করে হেসে দিয়ে অরূপ সম্পর্কে ঠিক একই মূল্যায়ন করবে, তখন আমাদের মনে হবে, অরুন হয়তো আসলে তাই ছিল শৈলজা তাকে যা বলতো।

বিলুদা এখনো ১৩/৮, জিন্দাবাহার লেনের বাড়িতেই থাকেন। আগে যেমন সবার টুকটাক ফাই-ফরমায়েশ খাটতেন, এখনো তাই খাটেন। সপ্তাহে দু’দিন মাঝরাত পর্যন্ত দেশি মদ খেয়ে মাতলামো করেন। কিন্তু একদমই হাসেন না। হাসেন না কেন, জানতে চাইলে কিছুই বলেন না। শুধু একটা নিরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে চলে যান।

**

The Bird wishes it were a cloud.
The Cloud wishes it were a bird.

অরুন আর শৈলজা একে অপরের কাছে আসতে পেরে যেন স্বস্তি খুঁজে পেয়েছিল। কি! আমি কিভাবে জানলাম? ঐ যে বইটা, যেটা শৈলজা অরুনকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল তার জন্মদিনে, তাতে শৈলজা লিখেছিল,

The Bird wishes it were a cloud.The Cloud wishes it were a bird.

শৈলজা লাইন দু’টো যে রবি ঠাকুরের ‘Stray Birds’ থেকে নিয়েছিল, তা আমি বুঝেছিলাম আরও অনেক পরে। অরুন আর শৈলজার মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়েছিল। শৈলজাদের ১৩/৮, জিন্দাবাহার লেনের বাড়িটার পুরো ছাদজুড়ে আর ছাদের বাইরে যতো গাছ আছে, সেগুলো অরুনকে চেনানোর ভার ছিল শৈলজার। বিনিময়ে অরুন শৈলজাকে পরিচয় করিয়ে দেবে তার ঘর ভরতি যতো বই সেগুলোর সাথে। অরুনের নেশা ছিল রবীন্দ্রনাথ। আস্তে আস্তে মনে হয় সেটা শৈলজার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল।

একদিন শাহবাগের পুরনো বইয়ের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে রিক্সার খোঁজ করছি; সঙ্গে মিলি আপা। আমরা বেইলি রোড যাবো। আমি আর মিলি আপা একই থিয়েটারের হয়ে নাটক করি। পুরো বছর জুড়ে বহু কষ্ট করে চার-পাঁচটা নাটক নামাই। দুটো চলে, তিনটা চলে না। পরেরটা যাতে চলে, সেজন্য উঠে পড়ে লাগি। কে জানে! হয়তো সেটাও চলবে না! তখন বেশ বুঝতে পারছি, এইসব নাটক-ফাটক করে আর চলছে না। যেমন চলছে না বিনামূল্যে মিলি আপা নামক এই বিবাহিত মহিলার দারোয়ানগিরি করে। রিকশা ঠিক করে উঠতে যাব, এমন সময় পিছন ফিরে দেখি, মিলি আপা দুজনের সাথে আলাপে মশগুল। মিলি আপার স্বভাব স্কচটেপের মতো। এক জায়গায় জুড়ে গেলে সহজে আর ওখান থেকে ছুটতে চান না। এদিকে আমি রিক্সাওয়ালাকে বুঝিয়ে যাচ্ছি, এই একটু এই আরেকটু বলে। কিছুক্ষণ পর আমাকেও ডাকলেন। মিনিমাম আধঘন্টার মামলা বুঝতে পেরে রিক্সাওয়ালাকে দিলাম ছেড়ে। মিলি আপা আমাকে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। অরুন আর শৈলজা। কথায় কথায় জানা গেল, শৈলজা মিলি আপার বান্ধবীর ছোট বোন। কালো জর্জেটের শাড়িতে বেশ লাগছিল তাকে দেখতে। আমার মনে হল, শৈলজা বুঝি কালো রঙে একটা গভীর দূরত্ব ঘুচিয়ে নিয়েছে নিজের চারপাশে, যে দূরত্ব সর্ষে খেতের শেষ সীমানায়, শালবনের নীলাঞ্জনে। মিথ্যে বলবো না, শৈলজাকে দেখে আমার মাথায় রবি ঠাকুরের এই লাইনটা নিজের মতো করে উঁকি মেরে গেল। একটা নাটকের জন্য মুখস্থ করতে হয়েছিল এক সময়।

এই কালো রঙটার প্রতি শৈলজার একটা অস্বাভাবিক রকমের দুর্বলতা ছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতাটা পড়েই তার কালো রঙটার প্রতি দুর্বলতা জন্মেছিল কিনা, সেটা আর এতো বছর পরে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। আমি বলতে পারব না।  কিন্তু এই কবিতাটা যে শৈলজার ভীষণ রকমের প্রিয় ছিল, সেটা আপনি অরুনের পোষা খয়েরিরঙা শালিখের পালকের গায়ের মতো খয়েরি রঙের ডায়েরিটা পড়লেই বুঝতে পেরে যাবেন। তখন আর আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। এক পশলা প্রবল বর্ষণের পর…

মিলি আপা মাঝে মাঝে এই ১৩/৮ জিন্দাবাহার লেনের বাড়িটায় আসেন। চিলেকোঠার ঘরটা বারবার ঘুরে ফিরে দেখেন। যে ঘরটায় এখন আমি থাকি। যে ঘরটায় একসময় অরুন থাকতো। আমি শেষ পর্যন্ত আর মিলি আপার বিনে পয়সার দারোয়ানগিরি ছাড়তে পারিনি। যেমন ছাড়তে পারিনি থিয়েটার। মিলি আপাকে না চাইলেও থিয়েটার ছাড়তে হয়েছিল। সে এক অন্য ইতিহাস!

***

Sorrow is hushed into peace in my heart like the evening among the silent trees.

নারী ও পুরুষের হৃদয়িক সম্পর্কের শেষ পরিনতি কী? বিয়ে? হয়তো সেটাই কাম্য। সব বেলায় কি তাই হয়! অরুন আর শৈলজার বেলায় কি তাই হয়েছিল?

একদিন বিকেলের  শো শেষ করে মিলি আপাকে সাথে নিয়ে বের হয়েছি। নিউ মার্কেট যাবো। মিলি আপাকে রিক্সায় বসিয়ে রেখে আব্বাস মামার দোকান থেকে এক কাপ পুদিনা পাতার চা আর একটা  গোটা সিগারেট শেষ করে মাত্র রিকশায় উঠবো। হঠাৎ অরুনকে দেখতে পেলাম আমাদের কমপ্লেক্সের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যেহেতু দেখতে পাননি তাই আমিই এগিয়ে গেলাম। কাছে যেয়ে দাঁড়াতেই আমাকে চিনতে পারল। অবাক হয়ে দেখলাম, তার মাথার চুলগুলো ভীষণ উষ্কখুষ্ক। চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে।

তুমি কীভাবে মরতে চাও? এই ধরনের প্রশ্ন নিশ্চয়ই কেউ কাউকে করে না! এমনকি নিজেকেও না! শৈলজাও নিশ্চয়ই করেনি! শৈলজা কি কোনদিন ভাবতে পেরেছিল, এতো তুচ্ছ উপায়ে তাকে মরতে হবে? সে একবার কোথায় জানি পড়েছিল, একটা লোক গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ-ই সামনে পড়া একটা কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিজেই মরে গিয়েছিল! লোকটা কেন এমন করলো এটা ভেবে তখন সে বেশ একটু অবাকই হয়েছিল। তার এই অবাক হওয়ার ব্যাপারটা পরে একদিন সে অরুনকেও জানিয়েছিল। অরুন এটা তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিল। লেখাটা এখনো আছে। এক পশলা প্রবল বর্ষণের পর শরতের মেঘমুক্ত আকাশ যেমন পরিষ্কার, অরুনের পোষা খয়েরিরঙা শালিখের পালকের গায়ের মতো খয়েরি ডায়েরিটায়, তেমনি পরিষ্কার করে লেখা আছে সব।

সেদিন ছিল শরতের ঠিক মাঝমাঝি। তুলোর মতো মেঘগুলো নাগরিক আকাশটাকেও যেন বঞ্চিত করতে চায়নি; হাজারো বিন্যাস নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল দূর থেকে দূরে। আরও দূরে। অরুন আর শৈলজার বিয়ের তখনো ঠিক এক সপ্তাহ বাকি। বিয়ের কার্ড ছাপানো শেষ। মিলি আপাকে টেলিফোন করে শৈলজা কার্ড ছাপানো শেষ হওয়ার খবরটা জেনে নিয়েছিল। মিলি আপার হাজব্যান্ড অন্য অনেক কিছুর সাথে এসবের বিজনেসও করেন। মিলি আপা বলেছিল, দুপুরের পর কাউকে পাঠালেই সে গিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। কাউকে মানে বিলুদাকে পাঠানো। বিলুদা শৈলজার মামাতো ভাই। কিছুটা আত্মভোলা ধরনের মানুষ। ঠিক কখন থেকে তিনি খালার বাসায় আছেন, তা বোধহয় তার নিজেরও মনে নাই। শৈলজাদের পরিবারের যে কাজগুলো আর কেউ করতে চায় না, সেগুলো তিনিই হাসিমুখে করে থাকেন। কার্ড ছাপানো শেষ হওয়ার খবরটা শৈলজা অরুণকে তখনো দেয়নি। বিকেলে তার হাতে মূর্তিমান কার্ডটা দিয়েই তাকে চমকে দিতে চায়।

১৩/৮ জিন্দাবাহার লেনটায় তখন শরতের বিকেল। চিলেকোঠার মরে যাওয়া রোদ, ধনুকের মতো বাঁকা নারকেল গাছটা থেকে সরে গিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো সাদা রঙের বাড়িটায়, যার নিচ দিয়ে একটু আগে বিলুদাকে আসতে দেখে শৈলজা অরুনকে চোখ বন্ধ করতে বলে নেমে গিয়েছিল। অরুন মাঝে মাঝে এক চোখ খুলে দেখে নিচ্ছিল, শৈলজা আসছে কিনা। এসবের কিছুই অবশ্য তখন আর শৈলজার জানবার কথা নয়।

আমার হাত থেকে বিয়ের কার্ডগুলো আগে থাকতে কেন নিল না শৈলজা? আমার হাত থেকে কার্ডগুলোকে এমন করে রাস্তার মাঝখানেই পড়তে হলো কেন? শৈলজাই বা কেন আগ-পাছ চিন্তা না করে রাস্তা পার হতে যাবে কার্ডগুলো আনার জন্য? আর যদি শৈলজা যাবেই, কেন একটা গাড়িকে তখনই আসতে হবে তাকে চাপা দেয়ার জন্য? এই সব প্রশ্নের আসলে কোন উত্তর হয় না। কোন উত্তর দেয়া যায় না। মাঝরাতে দেশি মদের নেশা যখন চুড়ায় উঠে, তখন বিলুদা এই সব প্রশ্নই নিজেকে করেন  আর নিজের গাল থাপড়ান, চুল টানেন। তখন তাকে আমি আর চিনি না। তখন তিনি অন্য এক বিলুদা।

মিলি আপাকে সেদিন শুধু বিয়ের কার্ডটা দেয়ার জন্যই অরুন এসেছিল। সবাইকে বিলি করা নাকি শেষ হয়েছে। আমাকে বলছিল, চিলেকোঠার ঘরটা ছেড়ে দিয়েছে। কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করলে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। আর কিছুই বলেনি। না, বলেছিল। বলেছিল, চাইলে আমি ঘরটা নিতে পারি। বললে ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবে। তারপর তার আর কোন খোঁজ পাইনি।

জিন্দাবাহার লেন! ভারি অদ্ভুত নাম। এবং অদ্ভুতভাবে এটাই এখন আমার ঠিকানা, আমার নিবাস। নিবাস বলতে চিলেকোঠার এই ছোট্ট ঘরটা; যার দরজা পেরোলেই কিনা ইয়া বড় ছাদ! ছাদময় ছড়ানো অসীম শুন্যতা। সেই শূন্যতার ভাষা কী, তা আমার জানা নেই।

****

নামহীন-গোত্রহীন

১.

‘দেখ্ রতন, কতদিন তরে বলা হইছে দোকানের সামনে কাস্টমার দেখলে গলা উঁচা কইরা ডাকবি। ভেতরে আইসা বসতে বলবি।’– এতো দ্রুত কথাগুলো বলতে থাকে ইদ্রিস আলী যে, কথার তোড়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা থুথুর ছিট গিয়ে পড়ে কাউন্টার হিসেবে ব্যবহৃত শেলফের উপর, ডিমের সালুন রাখা বড় বোলের ঠিক মাঝখানটিতে। সেদিকে একটিবার তাকায় সে। তাকিয়ে তার কোন ভাবান্তর হয় কিনা তা বুঝা যায় না। আর যাকে বলা হয়, সেই রতন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নিরুত্তর মুখে।

কাউন্টারের পরে একটা বেঞ্চ পাতা আছে কাস্টমারদের বসার জন্য। মানিক বসে ছিল সেখানে। বোলটা থেকে গরম ধোঁয়া বেশ একটা খুশবু নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল এবং ছড়িয়ে পড়ছিল আশেপাশের সবখানে। গন্ধটাই বলে দিচ্ছিল তরকারিটা মন্দ হয়নি। কিছুক্ষণ আগেও সে ভাবছিল- দাদার তো আসতে এখনো অনেক দেরি। এক প্লেট সাদা ভাত আর সাথে ধোঁয়া উঠা ডিমের সালুন পেটে চালান করে দেবে নাকি। কিন্তু, ইদ্রিস আলীর মুখ থেকে থুথুর ছিট ডিমের তরকারিতে পড়ার দৃশ্যটা তার চোখ এড়ায় নি। তাই এখন আর সেই ইচ্ছেটা তার একদমই নেই।

ইদ্রিস আলী তার ঘামে ভিজে যাওয়া শার্টটা খুলে দলা পাকিয়ে রাখে পাশের হলুদ বার্নিশ করা টুলটাতে। তারপর ভাঙা তালের পাখাটা নিয়ে বাতাস করতে করতে তার কাউন্টারের পাশে রাখা চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে। বসা মাত্রই চেয়ারটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে আর্তনাদ করে উঠে। এতেও তার ছন্দময় হাতপাখার ঝাপটানোতে কোন ছন্দপতন ঘটে না। সে বাতাস করে যেতেই থাকে। বাতাসের সাথে তার ভেজা, ঘর্মাক্ত শরীর থেকে উৎকট গন্ধ মানিকের নাকে না এসে পারে না। সে একটু সরে বসে।

দোকানের বাইরে পাতা বেঞ্চিতে বসে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছিল মানিক। প্রাইমারি স্কুলের বন্ধ গেইটটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সে। সেটার ডানে যে বটগাছটা আছে তার সামনে অনেক লোকের জটলা। সেখানে জোকারের মতো দেখতে বেঁটে একটা লোক হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। তার চারপাশে আয়তাকার ভাবে সাজানো আছে সাদা-ধূসর রঙের সারি সারি বয়াম। একটার উপর একটা, তার উপর আরেকটা। কোন বয়ামে কী আছে এবং তার কী গুনাগুণ সেগুলোই বলে যাচ্ছে সে। বিফলে মূল্য ফেরত দেওয়ার আশ্বাসও দিচ্ছে সে। জটলায় চ্যাংড়াদের ভিড়ই বেশি। ক্যানভাসারটা গোপন সমস্যার কথা বলতেই তারা একে অপরকে কনুই দিয়ে গোঁতা মারছে। আবার কেউবা তার সাথের জনকে উদ্দীপ্ত করার জন্য চিমটি কাটছে। মনে আছে, একটা সময় মানিকও ছিল তাদের মতোই। ক্যানভাসারের যৌন সুঁড়সুঁড়ি দেয়া কথাগুলোর জাবর কেটেই কাটিয়ে দিতে পারত কয়েকটা দিন। কিন্তু আজ এই সময়ে এসে সেসবের প্রশ্নই আসে না! টোটনের দিকে তাকালে তো না-ই। কত বয়স হল টোটনের? দশ পেরিয়ে এগারোয় পড়ল। তার আর সীমা-রই বা কত হল? পঁয়ত্রিশের কম তো নয় নিশ্চয়ই। আবার চল্লিশও না হয়ে যায়! মাঝে মাঝে এতো এতো সব স্মৃতি মনে এসে ভিড় করে যে, নিজেকে তখন অনেক বুড়ো বলে মনে হয়।

সন্ধ্যা হতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। স্কুল ছুটি হয়েছে সেই কখন! টোটনকে সে রিকশা করে পাঠিয়ে দিয়েছিল লতার সাথে। ইদ্রিস আলীর দোকানে তখন ছিল দুপুরের খাবার খেতে আসা মানুষের ভিড়। সে অবশ্য খেয়েই বেড়িয়েছিল বাড়ি থেকে। সেজন্য সীমাকে একটু আগেই দুপুরের রান্নাটা বসাতে হয়েছিল। জলপাই দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল আর শুক্তো। শেষে বরই আর নারকেল দিয়ে বানানো পাটালি গুঁড়ের চাশনি। এই জিনিসটা বরাবরই তার অনেক পছন্দের। আর মা এটা করতে পারতেন সব থেকে ভালো। কিন্তু, মা এখন নেই। তার প্রিয় হয়তো এ কারণেই সীমা মায়ের কাছ থেকে এটা বানানো শিখে নিয়েছিল।

হঠাৎ-ই বড় রাস্তাটার একেবারে মাথায় মানিক দেখতে পেল মাখনকে। পানি দিয়ে কুড়ে কুড়ে আঁচড়ানো চুল আর পিটপিট করে তাকানো চোখজোড়া নিয়ে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল মাখন। তার ডান হাতে একটা বাজারের ব্যাগ ধরা আছে। সেটা ভাঁজ করে হাতের মুঠোয় নিতে নিতে এগিয়ে আসছিল সে। সে আরও কাছে এসেই মানিকের দিকে তাকিয়ে একটা সরল হাসি উপহার দিলো তাকে। কিছুটা কৌতূহলে জানতে চাইলো,

বড়দাদা আসেন নাই এখনো? 

না। বাজারের লিস্ট আনছিস?- জিজ্ঞেস  করে মানিক। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে কাউন্টারের দিকে একটু সরে মাখনকে বসার জায়গা করে দিলো সে। মাখন সেখানে বসলো না। একটু দূরে রাখা ভাঙা বেঞ্চের এক কোণায় সাবধানে বসতে বসতে সে বলল,

বাবি (ভাবী) সবকিছু লেইখ্যা দিসে। শুধু লবনের কথা মনে আসিন না। আইবার সময় পিছন থেকে ডাক দিয়া কইসে লবণ নিবার কতা। আর কইল, ডাঙর দেইখ্যা মাছ কিনতে; লগে কাডারিবুগ চাইল।  

মাখনের এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে, কি মনে করে যেন তার দিকে মুচকি হাসল মানিক। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,

মিনুরে দেখতে আসছিল?

হ, বেডারা দেরি কইরা আইসে। তিনডা রিসকা কইরা আষ্টজন আইছিল। সেলের (ছেলের) বাপ, দুই চাচা, এক মামু, মা আর আরও কেডা কেডা জানি!

একটু থেমে ভাঙা বেঞ্চটায় একটু ভালো করে বসতে চাইলো মাখন। অমনিই সেটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে তার আর্তনাদ জানালো। মাখন মুহূর্তের জন্য মুখে কেমন একটা অপরাধীর মতো ভঙ্গি করলো। তারপর বলে চললো,

আমি যাই নাই। গরুর দুদ দুয়াইতে গিয়া দেরিং হইয়া গেসিন। যাওয়ারও কুনু নিয়ত আসিন না। খাইয়া-দাইয়া বাজারে আওয়ার লাইগ্যা খেত পাতারে নামসি। দেহি, রাস্তা দিয়া তিনডা রিশকা বাজারের দিকে যাইতেসে। রিশকাগুলার পিছন পিছন দ্যাখলাম মিনু আফার বাপ আর দুই বাই (ভাই)। আমি পাও চালাইয়া তাগরে গিয়া ধল্লাম।   মিনু আফার বাপেরে জিগাইতেই সব কইল। তুমার কতাও জিগাইল। কইল যে, তুমি যাও নাই কেন? 

তুই তখন কি বললি?

তহন আমি কইলাম, আইজ বড় দাদা আইবো। তুমি তারে আগাইয়া আনতে ইষ্টিশনে আইস। 

‘হু’ বলে একটা নাতিদীর্ঘ শব্দ করলো মানিক। ট্রেন আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। তার আগে মাছ কিনে মাখনকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। নইলে আবার ঠিক সময়ে খাবার দিতে সীমাকে হিমশিম খেতে হবে। আবার, দেরি করলে এদিকে পরে চাষের মাছ ছাড়া আর কোন মাছও পাওয়া যাবে না। এখন এই গ্রামেও টাকা দিয়ে কিনে মাছ খাওয়ার মানুষের অভাব নাই। কিন্তু, মাছই যে নাই! কিনবে কি? গ্রাম্য রাজনীতি, দালালি আর দলাদলি-বাটপারি করে কাঁচা পয়সার মুখ দেখেছে অনেকেই। কয়েক বছর আগেও জেলে অথবা জেলের সন্তান ছাড়া যার আর কোনও সামাজিক পরিচয়ই ছিল না বলতে গেলে, রাজনীতি আর দলাদলির সুযোগ নিয়ে এখন সে মস্ত বড় নেতা। আগে যেখানে পরের পুকুরে গভীর রাতে নিঃশব্দে জাল ফেলতে যার হাত দুইবার কাঁপত, অপরাধবোধে হৃদয় কিছুটা হলেও সিক্ত হত, তারই এখন দরিদ্র মানুষগুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দু’হাতে তাদের কলার চেপে ধরে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতেও বিন্দুমাত্র বাধে না। এই হল অবস্থা!

এইসব আগু-পিছু ভাবতে ভাবতে মানিক উঠে পড়লো। বেশি দেরি করে ফেললে আর মাছ পাওয়া যাবে না। দাদা আবার চাষের মাছ মুখেই নেয় না। কিন্তু, তাদের তো প্রায়দিনই ওই চাষের মাছগুলোই না চাইলেও খেতে হয়। নইলে যে মাছ না খেয়েই থাকতে হবে! আমাতরের বিল থেকে আর সাহেবগঞ্জ বাজার থেকে যে অল্প কিছু মাছ আসে, সেগুলো বাজারে উঠার মিনিট বিশেকের মধ্যেই বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায়। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ যারা বাজার করতে আসে, তারা ঐ মাছগুলোর আশা ছেড়ে দিয়েই অবশ্য বাজার করতে আসে। স্থানীয় এক ফিশারিজ থেকে আসা চাষের মাছগুলোর দিকেই থাকে তাদের নজর। তবুও তারা দাঁড়িয়ে থাকে ঐ বনেদি মাছের আরতের সামনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চমূল্যে মাছগুলোর বিক্রি হওয়া দেখে। দেখে ঐ মাছগুলোর যারা ক্রেতা তাদেরকেও। দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুদিন আগেও যার কাছ থেকে আড়ালে অন্যের পুকুরের চুরি করা মাছ কমদামে কিনত, ঐ বনেদি মাছের আড়তে তাকেই যখন তারা ক্রেতা হিসেবে দেখতে পায়, তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে তারা। এই বিনা পয়সার বায়স্কোপ যখন শেষ হয়, তখন নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে তারা ফিশারিজ কোম্পানির আড়তে এসে হাজির হয়। তাদের মাছগুলো তারা সেখানে খুঁজতে থাকে। ফিশারিজ কোম্পানির উপর তাদের এই নির্ভরতার সুযোগও ইদানিং নিতে শুরু করেছে যেন ফিশারিজ কোম্পানিটা। আগে যে সাইজের মাছ যে টাকায় মিলত, এখন সেই টাকায় মিলে তার প্রায় অর্ধেক সাইজের মাছ। তবুও তাদের উপর গ্রামের মানুষগুলো কিন্তু অখুশি নয়। বরং এই ফিশারিজ কোম্পানির দয়াতেই নাকি তাদের খাবারের তালিকায় এখনো টিকে আছে মাছ।

শুরুতে চাষের মাছ খেতে মানিকের কেমন জানি ভাতের মতো লাগতো। মাছের আসল গন্ধই নেই। কোন কোন মাছে আবার পাওয়া যেত উৎকট গন্ধ। কতদিন যে মাছের টুকরায় কামড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে ভাতের দলাসহ মুখ থেকে বের করে ফেলে দিয়েছে! কুলি করার পরও ওই উৎকট গন্ধ আর মুখ থেকে দূর করতে পারেনি। পরে সীমাই শেষ পর্যন্ত একটা কৌশল খুঁজে বের করেছিল। তরকারি রান্না করার সময় একদিন দিয়ে দিয়েছিল খানিকটা ধনেপাতা বাঁটা। তখন মাছের ওই উৎকট গন্ধ আর থাকেনি। তারপর থেকে রান্নাঘরে এই ব্যবস্থাই চলছে।

ইদ্রিস আলী’র দোকানে সন্ধ্যার বাতিগুলো জ্বলে উঠছে একে একে। যদিও সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেকটা সময় বাকি, তবুও ইদ্রিস আলী মনে করে তার কম চওড়া, বেশি লম্বা দোকানটার একটু ভিতরের দিকে সেসব কাস্টমার বসে চা খায় আর গল্প করে সেখানে, সন্ধ্যার আগের এই সময়টায় কিছুটা অন্ধকার থাকে। তাতে কাস্টমারদের বেশ অসুবিধা হয়। এইজন্যই তার দোকানে আশপাশের অন্যান্য দোকান থেকে সন্ধ্যা নামে একটু তাড়াতাড়ি।

তুই এখানেই থাক। কোথাও যাবি না।- ইদ্রিস আলী’র দোকানের হলুদ বাতিগুলো থেকে চোখ সরিয়ে মাখনের চোখে চোখ রেখে কঠিন করে কথাগুলো বলল সে।

তারপর মাখনকে চা আর রসগোল্লা খাওয়ার টাকা দিয়ে সাইকেল নিয়ে মাছবাজারের দিকে রওনা হল মানিক।