প্রথম পাতা » গল্প » নামহীন-গোত্রহীন

নামহীন-গোত্রহীন

১.

‘দেখ্ রতন, কতদিন তরে বলা হইছে দোকানের সামনে কাস্টমার দেখলে গলা উঁচা কইরা ডাকবি। ভেতরে আইসা বসতে বলবি।’– এতো দ্রুত কথাগুলো বলতে থাকে ইদ্রিস আলী যে, কথার তোড়ে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা থুথুর ছিট গিয়ে পড়ে কাউন্টার হিসেবে ব্যবহৃত শেলফের উপর, ডিমের সালুন রাখা বড় বোলের ঠিক মাঝখানটিতে। সেদিকে একটিবার তাকায় সে। তাকিয়ে তার কোন ভাবান্তর হয় কিনা তা বুঝা যায় না। আর যাকে বলা হয়, সেই রতন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে নিরুত্তর মুখে।

কাউন্টারের পরে একটা বেঞ্চ পাতা আছে কাস্টমারদের বসার জন্য। মানিক বসে ছিল সেখানে। বোলটা থেকে গরম ধোঁয়া বেশ একটা খুশবু নিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছিল এবং ছড়িয়ে পড়ছিল আশেপাশের সবখানে। গন্ধটাই বলে দিচ্ছিল তরকারিটা মন্দ হয়নি। কিছুক্ষণ আগেও সে ভাবছিল- দাদার তো আসতে এখনো অনেক দেরি। এক প্লেট সাদা ভাত আর সাথে ধোঁয়া উঠা ডিমের সালুন পেটে চালান করে দেবে নাকি। কিন্তু, ইদ্রিস আলীর মুখ থেকে থুথুর ছিট ডিমের তরকারিতে পড়ার দৃশ্যটা তার চোখ এড়ায় নি। তাই এখন আর সেই ইচ্ছেটা তার একদমই নেই।

ইদ্রিস আলী তার ঘামে ভিজে যাওয়া শার্টটা খুলে দলা পাকিয়ে রাখে পাশের হলুদ বার্নিশ করা টুলটাতে। তারপর ভাঙা তালের পাখাটা নিয়ে বাতাস করতে করতে তার কাউন্টারের পাশে রাখা চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে। বসা মাত্রই চেয়ারটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে আর্তনাদ করে উঠে। এতেও তার ছন্দময় হাতপাখার ঝাপটানোতে কোন ছন্দপতন ঘটে না। সে বাতাস করে যেতেই থাকে। বাতাসের সাথে তার ভেজা, ঘর্মাক্ত শরীর থেকে উৎকট গন্ধ মানিকের নাকে না এসে পারে না। সে একটু সরে বসে।

দোকানের বাইরে পাতা বেঞ্চিতে বসে চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছিল মানিক। প্রাইমারি স্কুলের বন্ধ গেইটটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সে। সেটার ডানে যে বটগাছটা আছে তার সামনে অনেক লোকের জটলা। সেখানে জোকারের মতো দেখতে বেঁটে একটা লোক হ্যান্ডমাইক হাতে নিয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। তার চারপাশে আয়তাকার ভাবে সাজানো আছে সাদা-ধূসর রঙের সারি সারি বয়াম। একটার উপর একটা, তার উপর আরেকটা। কোন বয়ামে কী আছে এবং তার কী গুনাগুণ সেগুলোই বলে যাচ্ছে সে। বিফলে মূল্য ফেরত দেওয়ার আশ্বাসও দিচ্ছে সে। জটলায় চ্যাংড়াদের ভিড়ই বেশি। ক্যানভাসারটা গোপন সমস্যার কথা বলতেই তারা একে অপরকে কনুই দিয়ে গোঁতা মারছে। আবার কেউবা তার সাথের জনকে উদ্দীপ্ত করার জন্য চিমটি কাটছে। মনে আছে, একটা সময় মানিকও ছিল তাদের মতোই। ক্যানভাসারের যৌন সুঁড়সুঁড়ি দেয়া কথাগুলোর জাবর কেটেই কাটিয়ে দিতে পারত কয়েকটা দিন। কিন্তু আজ এই সময়ে এসে সেসবের প্রশ্নই আসে না! টোটনের দিকে তাকালে তো না-ই। কত বয়স হল টোটনের? দশ পেরিয়ে এগারোয় পড়ল। তার আর সীমা-রই বা কত হল? পঁয়ত্রিশের কম তো নয় নিশ্চয়ই। আবার চল্লিশও না হয়ে যায়! মাঝে মাঝে এতো এতো সব স্মৃতি মনে এসে ভিড় করে যে, নিজেকে তখন অনেক বুড়ো বলে মনে হয়।

সন্ধ্যা হতে এখনো ঘণ্টাখানেক বাকি। স্কুল ছুটি হয়েছে সেই কখন! টোটনকে সে রিকশা করে পাঠিয়ে দিয়েছিল লতার সাথে। ইদ্রিস আলীর দোকানে তখন ছিল দুপুরের খাবার খেতে আসা মানুষের ভিড়। সে অবশ্য খেয়েই বেড়িয়েছিল বাড়ি থেকে। সেজন্য সীমাকে একটু আগেই দুপুরের রান্নাটা বসাতে হয়েছিল। জলপাই দিয়ে পুঁটি মাছের ঝোল আর শুক্তো। শেষে বরই আর নারকেল দিয়ে বানানো পাটালি গুঁড়ের চাশনি। এই জিনিসটা বরাবরই তার অনেক পছন্দের। আর মা এটা করতে পারতেন সব থেকে ভালো। কিন্তু, মা এখন নেই। তার প্রিয় হয়তো এ কারণেই সীমা মায়ের কাছ থেকে এটা বানানো শিখে নিয়েছিল।

হঠাৎ-ই বড় রাস্তাটার একেবারে মাথায় মানিক দেখতে পেল মাখনকে। পানি দিয়ে কুড়ে কুড়ে আঁচড়ানো চুল আর পিটপিট করে তাকানো চোখজোড়া নিয়ে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল মাখন। তার ডান হাতে একটা বাজারের ব্যাগ ধরা আছে। সেটা ভাঁজ করে হাতের মুঠোয় নিতে নিতে এগিয়ে আসছিল সে। সে আরও কাছে এসেই মানিকের দিকে তাকিয়ে একটা সরল হাসি উপহার দিলো তাকে। কিছুটা কৌতূহলে জানতে চাইলো,

বড়দাদা আসেন নাই এখনো? 

না। বাজারের লিস্ট আনছিস?- জিজ্ঞেস  করে মানিক। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে কাউন্টারের দিকে একটু সরে মাখনকে বসার জায়গা করে দিলো সে। মাখন সেখানে বসলো না। একটু দূরে রাখা ভাঙা বেঞ্চের এক কোণায় সাবধানে বসতে বসতে সে বলল,

বাবি (ভাবী) সবকিছু লেইখ্যা দিসে। শুধু লবনের কথা মনে আসিন না। আইবার সময় পিছন থেকে ডাক দিয়া কইসে লবণ নিবার কতা। আর কইল, ডাঙর দেইখ্যা মাছ কিনতে; লগে কাডারিবুগ চাইল।  

মাখনের এক নিঃশ্বাসে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে, কি মনে করে যেন তার দিকে মুচকি হাসল মানিক। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলল,

মিনুরে দেখতে আসছিল?

হ, বেডারা দেরি কইরা আইসে। তিনডা রিসকা কইরা আষ্টজন আইছিল। সেলের (ছেলের) বাপ, দুই চাচা, এক মামু, মা আর আরও কেডা কেডা জানি!

একটু থেমে ভাঙা বেঞ্চটায় একটু ভালো করে বসতে চাইলো মাখন। অমনিই সেটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে তার আর্তনাদ জানালো। মাখন মুহূর্তের জন্য মুখে কেমন একটা অপরাধীর মতো ভঙ্গি করলো। তারপর বলে চললো,

আমি যাই নাই। গরুর দুদ দুয়াইতে গিয়া দেরিং হইয়া গেসিন। যাওয়ারও কুনু নিয়ত আসিন না। খাইয়া-দাইয়া বাজারে আওয়ার লাইগ্যা খেত পাতারে নামসি। দেহি, রাস্তা দিয়া তিনডা রিশকা বাজারের দিকে যাইতেসে। রিশকাগুলার পিছন পিছন দ্যাখলাম মিনু আফার বাপ আর দুই বাই (ভাই)। আমি পাও চালাইয়া তাগরে গিয়া ধল্লাম।   মিনু আফার বাপেরে জিগাইতেই সব কইল। তুমার কতাও জিগাইল। কইল যে, তুমি যাও নাই কেন? 

তুই তখন কি বললি?

তহন আমি কইলাম, আইজ বড় দাদা আইবো। তুমি তারে আগাইয়া আনতে ইষ্টিশনে আইস। 

‘হু’ বলে একটা নাতিদীর্ঘ শব্দ করলো মানিক। ট্রেন আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। তার আগে মাছ কিনে মাখনকে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। নইলে আবার ঠিক সময়ে খাবার দিতে সীমাকে হিমশিম খেতে হবে। আবার, দেরি করলে এদিকে পরে চাষের মাছ ছাড়া আর কোন মাছও পাওয়া যাবে না। এখন এই গ্রামেও টাকা দিয়ে কিনে মাছ খাওয়ার মানুষের অভাব নাই। কিন্তু, মাছই যে নাই! কিনবে কি? গ্রাম্য রাজনীতি, দালালি আর দলাদলি-বাটপারি করে কাঁচা পয়সার মুখ দেখেছে অনেকেই। কয়েক বছর আগেও জেলে অথবা জেলের সন্তান ছাড়া যার আর কোনও সামাজিক পরিচয়ই ছিল না বলতে গেলে, রাজনীতি আর দলাদলির সুযোগ নিয়ে এখন সে মস্ত বড় নেতা। আগে যেখানে পরের পুকুরে গভীর রাতে নিঃশব্দে জাল ফেলতে যার হাত দুইবার কাঁপত, অপরাধবোধে হৃদয় কিছুটা হলেও সিক্ত হত, তারই এখন দরিদ্র মানুষগুলোর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে দু’হাতে তাদের কলার চেপে ধরে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতেও বিন্দুমাত্র বাধে না। এই হল অবস্থা!

এইসব আগু-পিছু ভাবতে ভাবতে মানিক উঠে পড়লো। বেশি দেরি করে ফেললে আর মাছ পাওয়া যাবে না। দাদা আবার চাষের মাছ মুখেই নেয় না। কিন্তু, তাদের তো প্রায়দিনই ওই চাষের মাছগুলোই না চাইলেও খেতে হয়। নইলে যে মাছ না খেয়েই থাকতে হবে! আমাতরের বিল থেকে আর সাহেবগঞ্জ বাজার থেকে যে অল্প কিছু মাছ আসে, সেগুলো বাজারে উঠার মিনিট বিশেকের মধ্যেই বেশ চড়া দামে বিক্রি হয়ে যায়। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ যারা বাজার করতে আসে, তারা ঐ মাছগুলোর আশা ছেড়ে দিয়েই অবশ্য বাজার করতে আসে। স্থানীয় এক ফিশারিজ থেকে আসা চাষের মাছগুলোর দিকেই থাকে তাদের নজর। তবুও তারা দাঁড়িয়ে থাকে ঐ বনেদি মাছের আরতের সামনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চমূল্যে মাছগুলোর বিক্রি হওয়া দেখে। দেখে ঐ মাছগুলোর যারা ক্রেতা তাদেরকেও। দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুদিন আগেও যার কাছ থেকে আড়ালে অন্যের পুকুরের চুরি করা মাছ কমদামে কিনত, ঐ বনেদি মাছের আড়তে তাকেই যখন তারা ক্রেতা হিসেবে দেখতে পায়, তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে তারা। এই বিনা পয়সার বায়স্কোপ যখন শেষ হয়, তখন নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে করতে তারা ফিশারিজ কোম্পানির আড়তে এসে হাজির হয়। তাদের মাছগুলো তারা সেখানে খুঁজতে থাকে। ফিশারিজ কোম্পানির উপর তাদের এই নির্ভরতার সুযোগও ইদানিং নিতে শুরু করেছে যেন ফিশারিজ কোম্পানিটা। আগে যে সাইজের মাছ যে টাকায় মিলত, এখন সেই টাকায় মিলে তার প্রায় অর্ধেক সাইজের মাছ। তবুও তাদের উপর গ্রামের মানুষগুলো কিন্তু অখুশি নয়। বরং এই ফিশারিজ কোম্পানির দয়াতেই নাকি তাদের খাবারের তালিকায় এখনো টিকে আছে মাছ।

শুরুতে চাষের মাছ খেতে মানিকের কেমন জানি ভাতের মতো লাগতো। মাছের আসল গন্ধই নেই। কোন কোন মাছে আবার পাওয়া যেত উৎকট গন্ধ। কতদিন যে মাছের টুকরায় কামড় দিয়ে মুখ বিকৃত করে ভাতের দলাসহ মুখ থেকে বের করে ফেলে দিয়েছে! কুলি করার পরও ওই উৎকট গন্ধ আর মুখ থেকে দূর করতে পারেনি। পরে সীমাই শেষ পর্যন্ত একটা কৌশল খুঁজে বের করেছিল। তরকারি রান্না করার সময় একদিন দিয়ে দিয়েছিল খানিকটা ধনেপাতা বাঁটা। তখন মাছের ওই উৎকট গন্ধ আর থাকেনি। তারপর থেকে রান্নাঘরে এই ব্যবস্থাই চলছে।

ইদ্রিস আলী’র দোকানে সন্ধ্যার বাতিগুলো জ্বলে উঠছে একে একে। যদিও সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেকটা সময় বাকি, তবুও ইদ্রিস আলী মনে করে তার কম চওড়া, বেশি লম্বা দোকানটার একটু ভিতরের দিকে সেসব কাস্টমার বসে চা খায় আর গল্প করে সেখানে, সন্ধ্যার আগের এই সময়টায় কিছুটা অন্ধকার থাকে। তাতে কাস্টমারদের বেশ অসুবিধা হয়। এইজন্যই তার দোকানে আশপাশের অন্যান্য দোকান থেকে সন্ধ্যা নামে একটু তাড়াতাড়ি।

তুই এখানেই থাক। কোথাও যাবি না।- ইদ্রিস আলী’র দোকানের হলুদ বাতিগুলো থেকে চোখ সরিয়ে মাখনের চোখে চোখ রেখে কঠিন করে কথাগুলো বলল সে।

তারপর মাখনকে চা আর রসগোল্লা খাওয়ার টাকা দিয়ে সাইকেল নিয়ে মাছবাজারের দিকে রওনা হল মানিক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান