এসো, নিঃসঙ্গতায় করি স্নান

রাস্তাটা সাপের মতন এঁকেবেঁকে
গেছে; গ্রামের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে
বিল ঘেঁষে, ঝিল ঘেঁষে; আঁকা হয়ে, বাঁকা হয়ে।
দূরে-অদূরের বয়েসি তালগাছগুলো
উঁকি দিয়ে দিগন্ত দেখার
তাল খুঁজছে। তার মাঝখান দিয়ে
আমি হেঁটে যাই একেলা, যেন
নিঃসঙ্গতায় করি স্নান।

এসো, নিঃসঙ্গতায় করি স্নান।

রাস্তা ছেড়ে আলের পথ ধরি।
রক্তিম সূর্যটাও হেঁটে চলে
আমার পিছু পিছু। জাতি-কড়ইগুলো
‘কেট’-এর মতো তাদের নগ্নতাকে ঢেকেছে
শিল্পের চাদরে। ধেয়ে আসা
উড়ন্ত বকের সারিগুলো
হঠাৎই দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়
কোন সুদূরে, যেন দিকচক্রবালে।
তার মাঝখান দিয়ে
আমি হেঁটে যাই একেলা, যেন
নিঃসঙ্গতায় করি স্নান।

এসো, নিঃসঙ্গতায় করি স্নান।

স্মৃত

la_solitudine__loneliness_

জীবন সাগরে নৌকা ভাসাই।
দাঁড় টানি; অবিশ্রান্ত।
খুঁজে ফিরি জীবনের নতুন কোন
বন্দর। একসময় পেয়েও যাই
আলোক-ঝলমল, প্রাণসঞ্চারী
সেই বন্দরের দেখা।
পাওয়ার তুষ্টিতে গা এলিয়ে দেই।
আকাশের দিকে উদাস মুখ রাখি।

হঠাৎ যেন বুকের বাঁ-পাশটা
চিনচিন করে উঠে।
ইতি-উঁতি করি;
কিন্তু-
দৃষ্টিসীমার মাঝে কোথাও দেখি না
সেই দূরের তারাটিকে;
যার দিকে তাকিয়ে ঘুম নামতো
আমার দু’চোখের পাতায়।
আর আমি ঘুমালে যে জ্যোৎস্না
আমার ঘুমন্ত মুখে আলো বিলাতো।

নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে।

ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল।
ইন্দ্রিয় সজাগ;
কিন্তু না! এ ডাকতো আমার সেই চেনা
মুনিয়া পাখির নয়! যে এতকাল
ঘুম ভাঙিয়েছে আমার।

হতাশার দৈত্য তোলপাড় শুরু করে।

তবে কি-
অচেনা পাখির একটানা চিৎকার
পুরনো বন্দরের জন্য
আমার বুকের ভেতরের
অব্যক্ত আর্তনাদ!

একটি বিশুষ্ক নদীর কাছে আমার প্রতিজ্ঞা

10

একটি বিশুষ্ক নদী-
ভরা যৌবন এখন যার অতীত।
তার কি কিছুই বলার থাকে না!
কিছুই কি বলবার নেই তার?

একসময় প্রায়ই যেতাম তার কাছে।
তখন ছিল তার ভরা যৌবন;
ছিল রূপ-সুধা-গন্ধ।
এখন?
কিছুই নেই আর অবশিষ্ট!

তবুও তার কাছে গিয়েছিলাম,
এই সেদিন।
আমাকে সে দিতে পারেনি কিছুই।
কিন্তু
আমার কাছ থেকে সে পেয়েছে অনেক;
শুধু
আমি তার কাছে গেছি বলে!

জীবনের কারণে ব্যস্ত এই আমি
তাকে প্রতিজ্ঞা দেয়ার মতো
করে বললাম, এমনটা আমি প্রায়ই করবো!

জানি না প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবো কতটুকু!

মনে হল-
যেন সে আশ্বস্ত হলো।
আবার পরক্ষনেই মনে হল যেন
সে অন্যদিক ফিরে
কেমন মিটিমিটি হাসল!

কি জানি বিশ্বাস করলো কতখানি!

এক সময় তো তবুও ফিরতেই হয়!
আমি তার দিকে চেয়ে বললাম, যাই?
দেখলাম
তার ঘোলাটে চোখজোড়া
কোথাও যেন স্থির।
অনেকটা নিজেকে বলার মতো করেই
সে বলল, যাও।
ফেরার সময় ভাবলাম, ‘যাও’ বলা ছাড়া
তার কাছে আর কোন
উত্তর জমা রেখেছিলাম কি!

স্মৃতিময় শহরের রূপকথারা

old-city-painting-rybakow-135-0

আমার স্মৃতিময় শহর;
আমার স্বপ্নালু চোখে এঁকে দিয়ে গেছে
কত শত স্বপ্নের আঁকিবুঁকি।
কত কত পাওয়া, না পাওয়ার উপকাহিনী।
বহুকাল ধরে ঐ চিলেকোঠার ধুলোজমা দেরাজে
পড়ে আছে ছেঁড়া ঘুড়ি, নাটাইয়ের জীর্ণ সুতো।
সেখানে এখনো স্বেচ্ছায় বন্দী
আমার কৈশোর।
তাকে তবে সেখানেই থাকতে দাও।

শাদা-শরত আকাশের নিচে,
ছাদের রেলিং ধরে হাঁটতে হাঁটতে
বেড়ে উঠেছে আমার চিন্তারা।
হয়তো সেখানে এখনো হাঁটছে তারা,
কোন এক চৈতালি ভরা জোছনায়।

নিঃসঙ্গ রাখালের বাঁশির মতো
গুমরে গুমরে কাঁদছে আমার ফেলে আসা
ভালোবাসা, বাতাসে উড়তে থাকা তার চুল,
গোলাপি ওড়না। উদাসী বিকেল আর
হিরণ্ময় দুপুরের মায়ায়
বাকিটা জীবন সেখানেই থাকুক তারা।

বিশ্বদা’র দোকানে এখনো লুকিয়ে
আছে আমার স্কুল ফাঁকির ঘণ্টাগুলো,
সিগারেটের ফিল্টারে প্রথম টান,
লাল চোখ আর দমকা কাশি।
অপরাধী’র মতন মুখ করে
সেখানেই লুকিয়ে থাকতে চায় তারা।
তবে তারা সেখানেই থাকুক, তারপর
নিমেষেই ভুলে যাক আর সব।
সিক্ত নীলাম্বরীর মতো ভিজে সারা
হোক অঝোর শ্রাবণে।

পরস্পর

553346_358558200927809_1410360259_n
যখনই আমি হেঁটে যাই
ওই ছোট্ট আলটি ধরে;
যদিও আমি জানি না
তার কী পরিচয়?
ডানে-বাঁয়ে যতোদূর চোখ যায়
শুধু দেখি-
আদিগন্ত ফসলের ক্ষেত;
ফসলের মওসুমে অবারিত
সবুজের মায়াজাল।
আর-
বর্ষায় বুকে ধারণ করে
এক খাড়ু জল।

দু’পাশে তার সারে সারে
বৃক্ষরাজি ডাল প্রসারিত করে:
নতুন-পুরনো পাতার
ছাউনি দিয়ে তৈরি করে
ছায়াপথ।
পূর্ণ সামরিক অভ্যর্থনা নিয়ে
তারা দাঁড়িয়ে থাকে যেন
আমার অপেক্ষায়।

কিছু দূরে দেখা যায়
কলিমের বাড়ির
নগ্ন ওঠোন; তার কিশোরী মেয়ে
এক খাবলা ভাত ছুঁড়ে দিয়ে
মোরগ-শালিখের
খ্যালা দ্যাখে
বসে বসে।
রশিদের মা’র কুকুর খেদানো
পাগল ছেলেটা লাঠি হাতে
ঝিমোয় বসে
পুকুরধারে।

হঠাৎ একটি অচেনা
কলমি ফুল অবাক তাকায়
আমার দিকে;
আমিও তাকে দেখি।
তার সংবেদ ছড়ানো পাতাগুলো
দোল খায় বাতাসে;
চিরকালীন দামাল ভঙ্গিতে।

তাদের সাথে কোনদিন
কথা বলিনি আমি।
তবুও মনে হয়;
তারা ও আমি- আমরা
চিরদিনের অন্তরঙ্গ
পরস্পর।